চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি) ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. এর নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, প্রফেসর ড. মো: সেলিম উদ্দিন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন। দেশের বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, বাজেটটি এমন এক সময় ঘোষিত হলো, যখন সমগ্র বিশ্ব মহামারি করোনা জনিত ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে রাশিয়- ইউক্রেনের প্রলম্বিত যুদ্ধ। এসব প্রতিকূলতার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি, ডলার সংকট, রিজার্ভে অব্যাহত চাপ, টাকার বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা তথা বহি:খাত আমদানী, রপ্তানী ও প্রবাসী আয় ইত্যাদি সূচকগুলো ক্রমশ: সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। ড. সেলিম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে জীবন যাত্রার ব্যয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এসময় তিনি আরও বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াস রয়েছে এ বাজেটে।
তিনি বলেন, ঘোষিত বাজেটের আকৃতি ৭ লক্ষ ৬১ হাজার সাতশত পঁচাশি কোটি টাকা যা বাংলাদেশের এযাবতকালের সর্ববৃহৎ । প্রস্তাবিত এ বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যথাক্রমে সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ এবং সাড়ে ৭ শতাংশ। এ বাজেট বাস্তবায়নের সম্ভাব্য মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লক্ষ ৩ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি দুই লক্ষ ৫৭ হাজার ৮শ’ পচাঁশি কোটি টাকার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে এর সংস্থান সম্পর্কে তথ্য প্রদান এবং খাত ভিত্তিক ব্যয় বরাদ্দের চিত্র তুলে ধরেন ড. সেলিম উদ্দিন। এ প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, প্রস্তাবিত বাজেটটি ২টি সরকার বাস্তবায়ন করবে বিধায় বাজেটের প্রতিটি বিষয়, বরাদ্দকৃত খাত, বাস্তবায়ন কৌশল, সরকারের দর্শন, স্বপ্ন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলে নেয়া–ইত্যাদি বিষয়গুলোতে আলাদা আলাদা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ড. সেলিম ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন ইতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোকপাত করে বলেন, বিশ্লেষন করলে অনেকগুলো ভাল ও গুণগত বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে এবারের বাজেটে। এগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে মুদ্রাস্ফীতি রোধ, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত রাখা, মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বয় সাধন, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি হ্রাস, দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা, রপ্তানী বহুমুখীকরণ, কর ব্যবস্থার যৌক্তিকীকরণসহ নানাবিধ প্রয়াস উল্লেখযোগ্য।
ড. সেলিমের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন- আয়কর মুক্ত সীমা ৩ লক্ষ টাকা থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকায় উন্নয়নের প্রস্তাব যা নারীসহ সিনিয়র সিটিজেনদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লক্ষ হতে ৪ লক্ষ টাকা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আয়কর সীমা ২৫ হাজার টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। নূন্যতম কর অপরিবর্তিত থাকলেও করযোগ্য সীমার নীচে যারা আয় বিবরনী দাখিলে যোগ্য তাদের প্রত্যেকের উপর নূন্যতম দুই হাজার টাকা কর ধার্য্য করা হয়েছে। সম্পদের সারচার্জের ক্ষেত্রে মোট সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি থেকে ৪ কোটিতে বৃদ্ধি হয়েছে এবং ৪ কোটি টাকার অধিক সম্পদের মালিককে ১০ শতাংশ হারে সারচার্জ এবং ৫০ কোটি টাকার উপরে ৩৫ শতাংশ সারচার্জ ধার্য্য হবে। এসব কর হার পরিবর্তনে নিম্ন আয়ের জনগণকে স্বস্তি, নূন্যতম ২ হাজার টাকা কর প্রদান করে কর সংস্কৃতি, সরকারী জনকল্যাণে অংশগ্রহণসহ কর জালের বিস্তারে পরোক্ষ ভূমিকা থাকবে। সম্পদ কর পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে আর্থিক স্বস্তি আসবে এবং ধনীক শ্রেণীর নাগরিকদের সম্পদের উপর অধিক সারচার্জ আয় বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে।
ড. সেলিম এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, দেশে ৮৮ লক্ষ ই-টিন ধারী থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে এবছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ৩১ লক্ষ সত্তর হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রিটার্ন দাখিল করেছেন। এই সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন কতিপয় সরকারি সেবা গ্রহণে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক জমাদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, টিআরপি (ঞধী জবঃঁৎহ চৎবঢ়ধৎবং) এর জন্য নীতিমালা তৈরি হবে। এসব পদক্ষেপ করের আওতা বৃদ্ধি এবং কর ব্যবস্হাপনায় স্বচ্ছতা ও কর সেবায় পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।
জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় হ্রাস, দেশীয় শিল্প সুরক্ষা, আমদানী বিকল্প শিল্প সুরক্ষা, রপ্তানী উৎসাহ, পণ্যের উৎপাদন ও যোগান স্বাভাবিক ও বৃদ্ধি, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে পণ্যমূল্যে স্বস্তিসহ আইসিটি ও অন্যান্য শিল্পখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ, কর ও শুল্ক ছাড় বা আরোপ প্রস্তাব করা হয়েছে। শুল্ক ছাড়ে দাম কমার তালিকায় মাংস,দেশীয় এলইডি বাল্ব, সুইচ সকেট, মিষ্টি, অভিজাত পোষাক, ই-কমার্সের ডেলিভারি চার্জ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর ফলে কৃষি সহজীকরণ এবং দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্প লাভবান হবে। অভিজাত পোষাকের শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে যা টেক্সটাইল শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিছু নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন- কলম, টয়লেট টিস্যু,মোবাইল ফোন ইত্যাদিতে ভ্যাট আরোপে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং বাজেটের মূল লক্ষ্য মুদ্রাস্ফীতি রোধের বিপক্ষে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, ভূর্তুকি, কৃষি, স্বাস্থ্য অর্থাৎ যে খাত গুলো নিম্ন আয়ের জনগন, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পকে সুরক্ষা দিবে সেসব খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মর্মে ড. সেলিম উল্লেখ করেন। বাজেটে খাদ্য-নিরাপত্তা ও খাদ্য কর্মসূচীগুলোর আওতা বাড়বে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মুদ্রাস্ফীতি থেকে স্বস্তি দিতে খোলা বাজারে স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছে বলেও ড. সেলিম উল্লেখ করেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি রোধে এবং বাজস্ব আহরণের অনেক কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমা সত্বেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎসে চাপ অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা, কর প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য গতিশীল কৌশল, রিজার্ভ বাড়ানো, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানী, শিল্পে জ্বালানী সরবরাহ ঠিক রেখে উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখাসহ বিভিন্ন সম-সাময়িক পরিস্থিতির উপর বাজেটে বলিষ্ট ভূমিকার কথা উল্লেখ থাকা প্রয়োজন মর্মে ড. সেলিম তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
সবশেষে তিনি এ বাজেটের সাফল্য অবশ্যই এর বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করবে এবং রাজস্ব আহরণকে অগ্রাধিকারমূলক মেগা প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে হবে বলে মতামত প্রদান করেন।