চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিগার সুলতানা। শিক্ষকতায় আসার পর ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষে অনিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে প্রথম পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। শেষ পর্বের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদনপত্র উপজেলা শিক্ষা অফিসে জমা দিয়ে রিসিভ কপিও নিয়ে আসেন। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলেও অনুমতিপত্র তখনও পাননি। বাধ্য হয়ে অনুমতি ছাড়াই নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশ নেন। পরে বেশ কয়েকবার উপজেলা শিক্ষা অফিসে ধরনা দিয়েও অনুমতিপত্র আর পাননি। উপজেলা অফিস থেকে জানানো হয়, তার আবেদন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, আবেদনপত্র পাওয়া যায়নি। নতুন করে অনুমতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ওই শিক্ষককে জানানো হয়, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে তাই এখন আর অনুমতি পাওয়া যাবে না।
সংসার, চাকরি, সন্তান-সন্তুতি সামলে গভীর রাত জেগে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাস্টার্সে উত্তীর্ণ হয়েও নিজের সার্ভিসবুকে তা সংযুক্ত করাতে না পেরে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন নিগার সুলতানা। মনে চাপা ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে এখনও শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন তিনি।
নিগার সুলতানার মতো সারাদেশের অন্তত সোয়া লাখ শিক্ষক নিজেদের উচ্চতর ডিগ্রি সার্ভিসবুকে অন্তর্ভুক্ত করতে না পেরে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তারা ক্ষুব্ধ। চাকরিরত অবস্থায় কষ্ট করে পড়াশোনা করেও অর্জিত ডিগ্রি তাদের পেশাগত ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসছে না। উচ্চতর পদে পদোন্নতির সুযোগও রুদ্ধ হচ্ছে। অনেকে শিক্ষা অফিসে মোটা অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে পূর্বানুমতি দেখিয়ে কিছু কিছু সনদ অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছেন বটে। তবে বেশিরভাগ শিক্ষকই তা পারেননি।
শিক্ষকরা জানান, আগে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের অ্যান্ট্রি পদে নারীদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক ও পুরুষদের জন্য স্নাতক ডিগ্রি যোগ্যতা নির্ধারণ করা ছিল। এই পদে ৬০ শতাংশ শিক্ষকই আবার নারী। তাই নারী শিক্ষকের বড় অংশই উচ্চমাধ্যমিক পাস করে এই চাকরিতে আসেন। পরে অনেকে ডিগ্রি ও মাস্টার্স করেন।
সহকারী শিক্ষকদের নতুন নিয়োগ বিধি-২০১৯ অনুযায়ী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি। তাই স্নাতক হয়েও অনেক নারী শিক্ষক সরকারি কাগজে-কলমে এখনও উচ্চমাধ্যমিক পাস। এ কারণে সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে উন্নীত করা হলেও এই শিক্ষকরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম আল হোসেন বলেন, আমরা চাই উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীরা প্রাথমিকের শিক্ষকতায় আসুক। এতে শিক্ষার মান উন্নত হবে। কর্মরত শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষার সনদ সার্ভিসবুকে অ্যান্ট্রি করার জন্য আমরা উদ্যোগ নেব।
প্রাথমিক শিক্ষকরা বলছেন, সিনিয়র সচিবের আশ্বাসে তারা অনেকটা ভরসা পাচ্ছেন। তবে মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা না হলে শেষ পর্যন্ত সার্টিফিকেট সংযুক্ত করা যাবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নোয়াখালী সদর উপজেলার দামোদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুসরাত ফেরদৌস জিলানী ও সাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কৃপা দাস দুইজনই অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার আগে চাকরিতে যোগদান করেন। নিয়মিত কোর্স হওয়ার কারণে ডিপার্টমেন্ট থেকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি না পাওয়ায় নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে তৃতীয় বর্ষ ও শেষ বর্ষের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাস করেন। কিন্তু সার্টিফিকেট সার্ভিসবুকে সংযুক্ত করতে পারেননি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেও তারা এইচএসসি পাস শিক্ষক হিসেবেই পরিচিত। বাধ্য হয়ে এখন আবার ডিপার্টমেন্টাল অনুমতি নিয়ে প্রাইভেট শিক্ষার্থী হিসেবে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছেন। আগের সার্টিফিকেট সংযুক্ত করতে পারলে তাদের নতুন করে আবার ভর্তি হওয়া লাগত না। আবার পরীক্ষার সময় এলে নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
জানা গেছে, এমন সমস্যা সোয়া লাখ প্রাথমিক শিক্ষকের। অনেকেই স্নাতক, সম্মান বা স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষে থাকা অবস্থায় চাকরিতে যোগদান করেছেন। কিন্তু সনদ সার্ভিসবুকে সংযুক্ত করার নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা তা সার্ভিসবুকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন না। ফলে ডিপার্টমেন্টে তারা কম শিক্ষিত হিসেবেই পরিচিত। নিজেদের আর্থসামাজিক মর্যাদা ও পদোন্নতির কথা চিন্তা করে তাদের সকলেই আবার প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করে শুধু একটি সনদের জন্য বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছেন। এতে করে তাদের মাঝেমধ্যেই নৈমিত্তিক ছুটি বা মেডিকেল ছুটি নিতে হচ্ছে। আবার অনেকে সার্টিফিকেট সংযুক্ত করতে পারবেন না এ আশঙ্কায় এই চাকরি ছেড়ে অন্য সরকারি বা প্রাইভেট চাকরিতেও চলে যাচ্ছেন। এই ভুক্তভোগী শিক্ষকদের একটাই দাবি, তাদের অর্জিত সনদগুলো সার্ভিসবুকে অন্তর্ভুক্তির অনুমতি দেওয়া হোক।
শিক্ষক নুসরাত ফেরদৌস জিলানী বলেন, ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছি। কিন্তু পূর্বানুমতি না থাকায় সনদ কোনো কাজে আসছে না। শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, সনদ অন্তর্ভুক্তি করার পরিপত্র আসা ছাড়া সনদ অন্তর্ভুক্ত করলে পরবর্তী সময়ে বিপদ হতে পারে। একই আশঙ্কা কৃপা দাসেরও। মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রই তাদের সমস্যা সমাধান করতে পারে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, বর্তমানে সকল শিক্ষকের নিয়োগ যোগ্যতা নূ্যনতম স্নাতক ডিগ্রি। তাই পরবর্তী নিয়োগগুলোতে ভূতাপেক্ষিক অনুমতি ছাড়া সনদ সার্ভিসবুকে অন্তর্ভুক্তিতে সমস্যা খুব একটা হবে না। তাই বিগত বছরগুলোতে যারা অনুমতি না নিয়ে সনদ অর্জন করেছেন তাদের সনদ অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের কর্মস্পৃহা বাড়বে।