রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় আহম্মেদ (২৭)। ফেসবুকের একটি গ্রুপে বিজ্ঞাপন দেখেন, ‘ফেসবুকে যাদের ফলোয়ার ১০ হাজার বা তার বেশি, তাদের অ্যাকাউন্ট ভেরিফাইড (ব্লু বেজ) করা যাবে।’
হৃদয়ের আইডিতে ফলোয়ার ছিল ৬৭ হাজার। তাই তিনি ওই বিজ্ঞাপন পোস্টে কমেন্ট করে জানতে চান, তার ফেসবুক আইডিটি ভেরিফাই করা যাবে কি না? উত্তরে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে তাকে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করতে বলা হয়। মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, তার আইডি ভেরিফাই করতে হলে ১০ হাজার টাকা আর অ্যাকাউন্টের ইমেইল ও পাসওয়ার্ড লাগবে। হৃদয় এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।
কিন্তু টাকাসহ সব তথ্য সরবরাহের পর দেখা গেল, তিনি আর তার আইডিতে প্রবেশ করতে পারছেন না। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন, তার আইডিটি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য একাধিক গ্রুপে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এরপর হৃদয় বুঝতে পারেন যে, তিনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে হৃদয়কে জানানো হয়, তার আইডি ফেরত পেতে হলে এক লাখ টাকা লাগবে।
শুধু হৃদয়ই নয়, এভাবে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করে দেওয়ার নামে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তাদের টার্গেট, সেলিব্রেটি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ অভিজাত শ্রেণির জনপ্রিয় লোক। এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি লোক এ চক্রের হাতে প্রতারিত হয়েছেন বলে ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে তথ্য রয়েছে।
সামাজিক মর্যাদাগত কারণে তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার। তিনি বলেন, হৃদয়ের করা একটি মামলায় শুক্রবার প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতা সৈকত মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এক দিনের রিমান্ডে তিনি নিজের প্রতারণা সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তার নেতৃত্বাধীন চক্রের সদস্যরা কেবল টার্গেট করা ব্যক্তিদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট লগআউট বা হ্যাক করে টাকা হাতিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট বিক্রি করে দিচ্ছেন দেশের বাইরে। তাছাড়া এসব অ্যাকাউন্টকে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা অপরাধ তৎপরতায়।
অনেক সময় দেখা যায়, জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নামে অনেকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে রাখেন। এ কারণে বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে কোনটি আসল আর কোনটি নকল অ্যাকাউন্ট। তাই জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আসল আইডি চিহ্নিত করতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ একটি অপশন চালু করেছে। সেটি হলো ‘ব্লু ভেরিফাইড ব্যাজ’।
যদি সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের নামের পাশে নীল বা হালকা কালো রঙের টিকচিহ্ন থাকে, তাহলে বোঝা যাবে সেটি আসল আইডি। বিষয়টিকে ‘ম্যাটার অব অ্যারিস্টক্রেসি’ বলে মনে করেন অনেকে। তাই নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন চান, তার ফেসবুক আইডি বা অ্যাকাউন্টটি ভেরিফাইড হোক।
আর এ চাওয়াকে পুঁজি করেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। অনেক সময় তারা আইডি ভেরিফাইড করে দেয়। কিন্তু আসলে সেটি ভেরিফাইড নয়। তবে যে কেউ দেখলে সহজেই মনে করবে আইডিটি ভেরিফাইড।
ডিবি সূত্র জানায়, নরসিংদীতে বসেই সৈকত মিয়া দেশ-বিদেশে বিস্তার করেছেন প্রতারণার জাল। শুক্রবার সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি কানাডায় থাকেন বলে ভেরিফাইড প্রত্যাশীদের কাছে প্রচার করতেন। সৈকত মিয়া পেশায় একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।
আট বছর ধরে তিনি ফেসবুক প্রতারণায় জড়িত। তিনি মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজাজিরা ও মরক্কোয় কিছু চক্রের কাছ থেকে ব্লু-ভেরিফাইড ফেসবুক আইডি কিনে তা ব্যবহার করে ছদ্মনামে প্রতারণা করে আসছিলেন। একেক সময় তিনি একেক আইডি ব্যবহার করেন। তার সবকটি আইডিই ভেরিফাইড। এ কারণে ভেরিফাইড প্রত্যাশী লোকজন সহজেই তাকে বিশ্বাস করতেন।
ভেরিফাইড প্রত্যাশী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান শাওন যুগান্তরকে বলেন, আমি অনেক দিন ধরেই আমার অ্যাকউন্টটি ভেরিফাইড করতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে রিকোয়েস্ট করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রিকোয়েস্ট পেন্ডিং ছিল। কোনো ফলাফল পাচ্ছিলাম না। এ কারণে আমি তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে ভেরিফাইড পেজের জন্য অবেদন করার চিন্তা করছিলাম। এ বিষয়ে ৫-৬ দিন আগে গুগলে সার্চ দিই।
সেখানে এ সংক্রান্ত একটি পেজ আসে। পরে সেটি ঘেঁটে আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। মনে হয় সেই পেজটি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত আছে। এরপর আমি সেখানে একটি স্ট্যাটাস দিই, ‘আই ওয়ান্ট টু ভেরিফাই মাই ফেসবুক।’ পরে এক লোক একটি কমেন্ট করে, ‘নক মাই মেসেঞ্জার’। পরে তার আইডি পর্যবেক্ষণ করে দেখি তার আইডি ভেরিফাইড। তার একেকটি স্টেটাসে হাজার হাজার লাইক-কমেন্টস। তার অবস্থান কানাডায়।
ফেসবুক ডেভেলপিংয়ের সঙ্গে জড়িত। ডেজিগনেশন ‘ব্লু ভেরিফাইড স্পেশালিস্ট’। এরপর তার সঙ্গে চ্যাটিং শুরু করি। তিনি টাকার বিনিময়ে আইডি ভেরিফাইড করতে ভোটার আইডি কার্ড অথবা পাসপোর্টের ফটোকপি এবং ২০ হাজার টাকা চান। পরে ১৫ হাজার টাকায় তিনি আমার আইডিটি ভেরিফাইড করে দিতে রাজি হন।
এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা অগ্রিম চান। বিকাশের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার আগে জানান, তিন দিনের মধ্যে আইডিটি ভেরিফাইড করে দেবেন। চার দিনের মাথায় তাকে মেসেঞ্জারে নক করা হলে তিনি আমার মোবাইল নম্বর চান। এর কিছুক্ষণ পর ডিবি অফিস থেকে আমাকে ফোন করে বলা হয়, আপনি যাকে নম্বর দিয়েছেন তিনি একজন প্রতারক। আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি। পরে ডিবি অফিসে গেলে ওই ব্যক্তি (সৈকত মিয়া) আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
প্রতারিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হৃদয় আহম্মেদ যুগান্তরকে বলেন, ২২ ডিসেম্বর আমি ফেসবুকে দেখতে পাই, চার্লস অ্যান্ডার্স ব্রাইন নামের একটি আইডি থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে-‘১০ হাজার টাকায় যেকোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বিশেষ সিকিউরিটি হিসেবে ব্লু ভেরিফাইড করা হয়।’ পরে প্রতারণার শিকার হই।