বঙ্গবন্ধুর পলাতক আত্মস্বীকৃত চার খুনি শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাব স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে এক রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়েছে, এই চার খুনির নামের আগে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাব পাওয়া ‘বীর বিক্রম’, ‘বীর উত্তম’, ‘বীর প্রতীক’ খেতাব খেতাব স্থগিত করা হলো।
সেই সঙ্গে এই চার খুনির খেতাব বাতিলে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রতি চার খুনির খেতাব স্থগিতের এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জাতির জনককে সপরিবারে হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই চারজনের খেতাব বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাশ এই রিট আবেদন করেন। আদালতের রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান।
রিট আবেদনে বলা হয়-
‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ও গেজেটে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর পলাতক ছয় খুনির অন্যতম নূর চৌধুরীর নামের সঙ্গে ‘বীর বিক্রম’, শরিফুল হক ডালিমের নামের সঙ্গে ‘বীর উত্তম’, রাশেদ চৌধুরীর নামের সঙ্গে ‘বীর প্রতীক’ ও মোসলেহ উদ্দিন খানের নামের সঙ্গে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি রয়েছে।
আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের ১১ অগাস্ট ওই তালিকা সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছে। অথচ ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ওই চারজনসহ মোট ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে ঢাকার দায়রা জজ আদালত। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ সেই মামলার চূড়ান্ত রায় দেন।
খেতাব স্থগিত হওয়া চার খুনির অবস্থান-
শরীফুল হক ডালিম: ১৯৯৫ সালে কেনিয়াতে রাষ্ট্রদূত থাকার সময়ে অবসরে যান ডালিম। বর্তমানে তিনি পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হলেও এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় সরকার।
মোসলেম উদ্দিন: বঙ্গবন্ধুর এই খুনি ইউরোপের কোনো একটি দেশে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হলেও এই সম্পর্কেও নিশ্চিত কোন তথ্য নেই সরকারের হাতে।
রাশেদ চৌধুরী- রাশেদ চৌধুরী ১৯৯৬ সালে ব্রাজিল থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটি অঙ্গরাজ্যে আছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চেয়ে অন্তত পাঁচবার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। এরপর ২০১৮ ও ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। আশা করা হচ্ছে এবছরের মধ্যে এ বিষয়ে একটি আইনি সিদ্ধান্ত দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল।
এবিএমএইচ নূর চৌধুরী: এই খুনির বসবাস কানাডায়। তাকে ফেরাতে আইনি লড়াই চলছে। তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর আগে ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা প্রি-রিস্ক রিমুভাল অ্যাসেসমেন্টের (পিআরআরএ) বিষয়ে রায় পেতে গত বছরের জুলাইয়ে কানাডার সরকার কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা করেছে। এ বছরের মার্চে মামলার শুনানি শেষ হয়। সেপ্টেম্বরে নূর চৌধুরীর অবস্থানের বিষয়ে রায় বা মতামত দেয়ার কথা ছিল কানাডার আদালতের। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটি পিছিয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ-
১৯৯৬: জাতির জনককে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ সুগম করে।
১৯৯৬: ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির সেই বাড়ির রিসেপনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন ।
১৯৯৮: বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি।
২০০০: এরপরে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী মামলাটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, খালাস পান তিন জন।
২০০৯: ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে।
২০১০: ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
২০০২: বাকি আসামিরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। এদের আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে খবর এলেও হত্যা মামলার নথিতে তার মৃত্যুর কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকায় তাকে পলাতক দেখানো হয়।
২০২০: সবশেষ ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদের। দুই দশকেরও বেশি সময় ভারতে পালিয়ে থাকার পর এ বছরের ৭ এপ্রিল দেশে ফেরার পর মাজেদ ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তার হন। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গত ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।