নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গ বানাতে মাটি কেটে সামনে চলছে দৈত্যাকায় টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম)। পেছনে একে একে সেগমেন্ট, রিং জোড়া লেগে তৈরি হচ্ছে টিউব।
যার ভেতর দিয়ে চলবে গাড়ি।
শুধু টিউব তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নেই কাজ। নদীর দুই তীরে চলছে সংযোগ সড়ক, ওড়াল সেতু নির্মাণসহ বিশাল কর্মযজ্ঞ। পালা করে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী আর শ্রমিক।
এই চিত্র কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্প এলাকার। সোমবার (২১ ডিসেম্বর) নগরের পতেঙ্গা এবং আনোয়ারা প্রান্তে প্রকল্প এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের ৬১ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আনোয়ারা প্রান্তে টিবিএম দিয়ে দ্বিতীয় টিউব তৈরির কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১২ ডিসেম্বর শুরু হওয়া দ্বিতীয় টিউব নির্মাণকাজ ঘিরেই এখন ব্যস্ত এ প্রকল্পের প্রকৌশলী আর শ্রমিকেরা।
দ্বিতীয় টিউব নির্মাণ করতে টিবিএম দিয়ে মাটি খননের পাশাপাশি কংক্রিটের সেগমেন্ট দিয়ে রিং তৈরি করা হচ্ছে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জেংজিয়ান শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে তৈরি ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্ট বসবে দুই টিউবে। এরমধ্যে ১৫ হাজার ৭৮৪টি সেগমেন্ট প্রকল্প এলাকায় এসেছে। বাকিগুলো অল্প দিনের মধ্যে আসবে।
এছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে টানেলের মুখ থেকে মূল সড়কে উঠতে তৈরি করা হচ্ছে ৭২৭ মিটারের একটি উড়াল সেতু। ইতোমধ্যে এই উড়াল সেতুর সবগুলো পিলার স্থাপন শেষ হয়েছে। এখন গার্ডার এবং স্ল্যাব তৈরির কাজ শুরু হবে।
উড়াল সেতুর শেষ প্রান্ত থেকে আনোয়ারা চাতুরী চৌমুহনী পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোডের মাটি ভরাটের কাজ চলছে। এই অ্যাপ্রোচ রোড দিয়েই শিকলবাহা জংশন হয়ে টানেলের গাড়ি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে উঠবে।
অন্যদিকে পতেঙ্গা প্রান্তে সিটি আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং টানেলের প্রবেশমুখে আধা কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি ওয়ার্কিং শাফট ও কাট অ্যান্ড কভার নির্মাণের কাজ চলছে এই জায়গায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, প্রায় ৯০০ জন শ্রমিক দিন-রাত টানেল নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছেন। এর মধ্যে ৬০০ বাংলাদেশি এবং ২৯০ জন চীনা নাগরিক।
তিনি বলেন, টানেলের দুই টিউবের মধ্যে একটির কাজ শেষ। অন্যটি তৈরির কাজ চলছে। এর পাশাপাশি সংযোগ সড়কসহ টানেল সংশ্লিষ্ট অন্য কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ৬১ ভাগ কাজ শেষ করেছি আমরা।
আনোয়ারা প্রান্তে টানেলের মুখ থেকে মূল সড়কে উঠতে তৈরি করা হচ্ছে ৭২৭ মিটারের একটি উড়াল সেতু। ছবি: সোহেল সরওয়ার
‘এখন যেভাবে কাজ চলছে- এভাবে কাজ করা গেলে ২০২২ সালের মধ্যেই টানেলের সব কাজ শেষ করতে পারবো আমরা। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করে টানেল গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে। ’ বলেন প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ।
চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দরনগর চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে গড়ে তুলতে নগরের পতেঙ্গা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।
দুই টিউবের এই টানেল নির্মাণকাজ শেষ হলে ৪ লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে।
এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং পূর্বপ্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্বপ্রান্তে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।