এম.পলাশ শরীফ:: কিছুতেই যেন লাগাম টানা যাচ্ছেনা সুন্দরবনের চোরা শিকারী চক্রের। পাচারের ক্ষেত্রে ওই সকল চক্রের প্রধান টার্গেট বনের হরিন ও বাঘ। করোনার সুযোগ নিয়ে শিকারীরা সুন্দরবন থেকে বাঘ ও হরিন শিকারের এক প্রকার প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। আর এ সকল শিকারী চক্রের সাথে জড়িত থাকার গুঞ্জন রয়েছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীনের । তিনি শরণখোলা রেঞ্জে যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন চোরা শিকারী চক্রের সাথে সখ্যতা তৈরী করে নানা অপকর্মের মাধ্যেেম অর্থ হাতানোর ধান্ধায় মেতে উঠেন। ফলে অপরাধ দমনে ব্যর্থ হচ্ছেন বন রক্ষার দ্বায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
জানা গেছে, ২০২১ সালের গত দুই মাসের ব্যাবধানে একটি বাঘ ও ১৯ টি হরিণের চামড়া এবং তিন মন হরিণের মাংস সহ ১৪ জন চোরা শিকারী ও পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারী শরণখোলা উপজেলার রাজৈর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি বাঘের চামড়া সহ উপজেলার সাউথখালী এলাকার বাসিন্দা জেলে মো. গাউস ফকির (৫০)কে আটক করে র্যাব-৮। জিজ্ঞাসাবাদে ওই জেলে জানায়, বাঘের চামড়াটি শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন সোনাতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহরাপ হোসেনের ছেলে মো. ওহিদুল এবং মো. ওবায়দুল বিক্রির জন্য তার কাছে দেন।
গত ২২ জানুয়ারী উপজেলার রায়েন্দা রাজৈর কেন্দ্রীয় বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় বাগেরহাট জেলা (গোয়েন্দা পুলিশ) ডিবির একটি দল অভিযান চালিয়ে ১৯টি হরিণের চামড়া সহ বাগেরহাট সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. মোশারফ শেখের ছেলে ড্রাইভার মো. মনির হোসেন শেখ (৪৫) এর বাসা থেকে ১৯টি হরিনের চামড়া উদ্ধার করে। এ সময় তার স্বীকারোক্তি মতে, রাজৈর গ্রামের বাসিন্দা ও বন্যপ্রানী পাচার চক্রের (সাবেক) সদস্য মো. মতিয়ার রহমান কাজী (ওরফে মতি কাজীর) ছেলে ও উপজেলা প্রসাশন মার্কেটের মুরগী ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস কাজী (৩৫)কে আটক করেন। ৩১ জানুয়ারী শরনখোলা উপজেলার দক্ষিন রাজাপুর এলাকা থেকে ২০ কেজি হরিনের মাংস সহ যশোর ঝিকারগাছার দেওয়ালী গ্রামের বাসিন্দা আঃ লতিফ মোড়লের ছেলে ও রায়েন্দা বাজার এলাকার ভাড়াটিয়া মো. মিলন শেখ (৩৫)কে আটক করে বনরক্ষীরা। এ সময় মিলন জানায়, শরনখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে তিনি বিয়ে করার সুবাদে বহুদিন আগে তার সাথে পুর্ব সুন্দরবনের শরনখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন ঢালীরঘোপ এলাকার বাসিন্দা মো. হাবিব তালুকদার, মো. তানজের বয়াতী ও বকুলতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. চাঁন মিয়া হাওলাদার (ওরফে চাঁন্দু) সাথে পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে সুন্দরবন হতে তাদের শিকার করা হরিনের মাংস সে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছিলেন।
অপরদিকে, ৩০ জানুয়ারী মোংলা কোষ্টর্গাড অভিযান চালিয়ে ৪৭ কেজি হরিনের মাংস ও একটি মাথা সহ খুলনার দাকোপ এলাকার মোনা সর্দার (৩২) রামপাল এলাকার জাহিদ শেখ (৩৮) ও মোংলার চিলা এলাকার বাসিন্দা শহীদুল শেখ (৪৫)কে আটক করেন। ৭ ফেব্রুয়ারী হরিনের ৪ টি পা সহ মোংলা উপজেলার বুড়বুড়ি গ্রামের এসমাইল মোল্লার ছেলে জাহাঙ্গীর মোল্লা (৪০) ও আবজাল শিকারীর ছেলে ফজলু শিকারী (৫০) ও ১৮ ফেব্রুয়ারী ২২ কেজি হরিনের মাংস সহ ১ জন কে আটক করে।
সর্বশেষ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ১ ফেব্রুয়ারী রামপাল উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৪২ কেজি হরিনের মাংস, ৩টি মাথা সহ মো. আ. রহমান শেখ (৫২) এবং তার ছেলে মো. মোস্তাকিন শেখ (২৭) কে আটক করে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন কায়দায় শিকার করে আনা বন্যপ্রানীর অঙ্গপ্রতঙ্গ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের সীমানা পেড়িয়ে চলে যায় আর্ন্তজাতিক চোরাই বাজারে।
তবে, এসব চক্রের হোতারা রহস্যজনক কারনে সব সময় পর্দার অন্তরালে থাকায় বন্যপ্রানী পাচারকারী চক্রের লাগাম টানা যাচ্ছেনা বলে অভিমত বন বিশেষজ্ঞদের। এ পর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৪ টি বাঘের নানা কারনে মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় গ্রামবাসীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে ১৪টি। আর চোরা শিকারীরা বিভিন্ন পন্থায় ও ফাঁদ ব্যবহার করে হত্যা করেছে ২৬টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
জেলে গাউস ফকিরের স্ত্রী মোসা তহমিনা বেগম (৪০) বলেন, আমার স্বামী একজন নিরীহ জেলে ঘটনার কয়েকদিন আগে তার কাছে শুধু ফোন আসতে দেেিখছি। তাকে প্রভাবশালীরা টাকার লোভ দেখিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।
এছাড়া নাম গোপন রাখার শর্তে শরনখোলা এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, জেলে গাউস ফকির এক সময়ে চান্দুর সাথে বনের বিভিন্ন এলাকায় মাছ ধরতেন। উদ্ধার হওয়া বাঘের চামড়ার সাথে চান্দু জড়িত থাকতে পারে এবং শরনখোলা রেঞ্জের (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীনের খুব আস্থাভাজন লোক হচ্ছে জেলে নামধারী চান্দু হাওলাদার। সে এসিএফ জয়নাল আবেদীনের এর দোহাই দিয়ে সুন্দরবনের নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরা সহ বন্যপ্রানী নিধনে লিপ্ত বয়েছে। চান্দুর ভাই মো. নাছির হাওলাদার সুন্দরবনের জ্ঞানপাড়া টহল ফাড়ির ট্রলার ড্রাইভার থেকে হরিন পাচারকারীদেরকে সহয়তা করে যাচ্ছে।
এসকল বিষয়ে অস্বীকার করে চান্দু বলেন, এক সময়ে জয়নাল স্যার আমাকে কিছু কাজকর্ম দিতেন। এখন আর কোন কাজ দেন না। তাছাড়া সুন্দরবনে আমি বৈধ ভাবে প্রবেশ করে পাশ পারমিট (অনুমতি) নিয়ে মাছ ধরি। তবে বন্যপ্রানী ও বনসম্পদ পাচারের সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নাই। প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীরা আমার নামে মিথ্যা বদনাম রটাচ্ছে।
অপরদিকে, ব্যবসায়ী ইলিয়াস কাজীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম বলেন, হরিনের চামড়ার বিষয়ে আমার স্বামী কিছুই জানে না। প্রতিপক্ষরা তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়েছেন।
সুন্দরবন সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি ও উপজেলা কৃষকলীগ নেতা মো. ওয়াদুদ আকন বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রানী নিধনের ক্ষেত্রে বন সংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালীরা অনেকটা দায়ী। কিছু অসাধু লোক তাদের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপকর্ম করে আসছেন। পাশাপাশি বনবিভাগের বর্তমান কর্মকর্তা জয়নাল সাহেব সুবিধা জনক লোক নয় । টহল টহল ব্যবস্থা জোরদার না থাকার কারনে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা মটর সাইকেল সহ বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকা, চট্রগ্রাম, বাগেরহাট সহ দেশের নানা প্রান্তে হরিনের মাংস সহ বন্যপ্রানীর অঙ্গপ্রতঙ্গ পাচার করার সাহস পাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ২/১টি চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশই ধরা ছোয়ার বাইরে। নিয়ম অনুযায়ী জেলেদের সকল নৌকা ও ট্রলার বনে প্রবেশ কালে এবং বের হওয়ার সময় বনরক্ষীরা তল্লাশী করবেন কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রে ম্যানেজ হয়ে সঠিক ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে না। তাছাড়া পুলিশের টহল বৃদ্ধি করে ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেল সহ ঢাকা চট্রগ্রামগামী পরিবহনগুলোর দিকে নজরদারী বাড়ানো হলে পাচার কার্যক্রম কিছুটা বন্ধ হবে।
এ বিষয়ে জানতে শরনখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীনের ০১৭১৬ ২২৫৭০৪ নম্বরের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। শরনখোলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাইদুর রহমান জানান, পুলিশ সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারী বৃদ্ধির কারনে পাচারকারীরা আটক হচ্ছে এবং শরনখোলা থানা পুলিশের টহল ব্যবস্থা পুর্বের চেয়ে ইতিমধ্যে আরো জোরদার করা হয়েছে।
এছাড়া পুর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, চোরা শিকারীদের ধরতে অভিযান চলছে এবং বন্যপ্রানীর অবাধ বিচাররনের জন্য সুন্দরবনের ৫০ভাগ এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া পাচারকারী চক্রের হোতাদের নজরদারীতে রাখা হয়েছে। প্রমান সাপেক্ষে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
খুলনা বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (সিএফ) মোঃ মহিউদ্দিন খাঁন বলেন, সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন রেঞ্জে আগের চেয়ে অপরাধ প্রবনতা বেড়েছে এজন্য বনবিভাগের নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এসব পাচার কাজে সাথে যদি বন বিভাগের কোন কর্মকর্তা কর্মচারী জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।