চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ বন্ধ হচ্ছে দেশের সব সরকারী পাটকল। সরকারের তরফে বলা হয়েছে পুরনো প্রযুক্তিতে কারখানাগুলো আর চলছে না। প্রায় পঁচিশ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসর দেয়া হচ্ছে। ছোট বেলায় স্কুলে আমরা ‘পাট’ রচনায় পড়েছি ‘নারায়ণগঞ্জকে বাংলার ডান্ডি বলা হয়।’ বড় হয়ে জেনেছি ডান্ডি বিখ্যাত হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকায় আমাদের পাট। স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরের পাটবস্ত্র কলে কাঁচামাল যোগান দিয়ে আমাদের কৃষক নিঃস্ব আর ওদেশে বিকশিত হয় নব্য ধনিক। কারখানার সাইরেনে সাইরেনে শিল্প বিপ্লবের আগমনী স্পষ্ট হয়। ধারাবাহিকতায় সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণী নিয়ে আসে ফরাসী বিপ্লব। জন্ম হয় চার্লস ডিকেন্স, জেন অস্টিন, শার্লট ব্রন্টিদের। ও মাপের ঘটনা আমাদের এখানে ঘটেনি। বাই প্রোডাক্ট সাহিত্যের জন্মও হয়নি। যেটুকু আলোড়ন এখানে লেগেছিল এবং তাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রায় সবটুকু স্ববিরোধিতায় ভরা। পাট নিয়ে আমাদের পড়ালেখা হরলাল রায়ের পাট রচনা মুখস্থের মধ্যেই সীমিত- ‘পাট আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল, পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয়…।’ তা হোক, বিল-পুকুরে পচানো পাট ততদিনে কারখানায় উঠেছে। কারখানার চাকায় লেগেছে শ্রমিকের হাত। প্রধান অর্থকরী ফসল বৈদেশিক মুদ্রা যা আনল তা ভিনদেশী শাসকের পকেটেই গেল। বঞ্চনার ক্ষোভে এক হয়ে শ্রমিক-কৃষক গত শতকের তিরিশ দশকে এমনকি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেও ফুঁসেছিল। তিরিশের পথ বেয়ে ষাট। ছয় দফার প্রাণ ছিল ঐ পাটেই। পাট চাষী আর শ্রমিকের বঞ্চনা ছয় দফায় প্রাণসঞ্চার করেছিল আর সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছিল দ্রুততর। সেই পাট আর পাটকল ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের শিকার হয় স্বাধীন দেশে সামরিক শাসকদের খপ্পরে পড়ে। ১৯৮২ সালে জেনারেল শাসকের শিল্পনীতি ঐতিহ্যের পাট, শ্রমিকের পাটকল, কৃষকের ক্ষেত ধ্বংসের প্রশস্ত পথ তৈরি করে। স্তব্ধ হয় কারখানার সাইরেন। আদমজী, কওমী, পিপলস পাটকলের মতো প্রথম সারির কলসহ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব কল একে একে বন্ধ হয়।
এরপর থেকে থেকে পাট নিয়ে নানান ইতিবাচক খবর শোনা গেছে। যেমন দু’হাজার এগারোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্ধ থাকা কওমী ও পিপলস জুট মিলের কার্যক্রম উদ্বোধন করে বন্ধ থাকা আরও সাত পাটকল শীঘ্র চালু করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের জন্য এর মধ্যে এক হাজার পঁচিশ কোটি টাকা দিয়েছে তার সরকার। একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া কারখানাগুলোর তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করেছে। কলগুলো চালু হলে সরকারী ব্যবস্থাপনায় উৎপাদনে যাওয়া পাটকলের সংখ্যা হবে বিশ। ধারাবাহিকভাবে উৎপাদনে যাবে দৌলতপুর জুট মিলস, কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাত জুট মিলস লিমিটেড। শোনা গিয়েছিল পাটের উৎপাদন ও রফতানির হারও বেড়েছে অনেক। যাবতীয় সীমাবদ্ধতার পরও সে বছর পাট ও পাটপণ্য রফতানি আগের বছরের চেয়ে ৫৩ শতাংশ বেড়েছিল। দেশী বাজারেও পাট গুরুত্ব পেয়েছিল আগের বছরের চেয়ে ৭৬ শতাংশ বেশি। দু’হাজার দশ-এগারো অর্থবছরে মোট রফতানি হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পাট ও পাটপণ্য। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৪০ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সিনথেটিকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। প্রাকৃতিক আঁশ পাটের ব্যবহার ও দামও তাই বেড়েছে। এসব অনেক কথা শোনা গিয়েছিল।
কিন্তু তাতে দেশের পাটকল ও পাট চাষ লাভজনক খাতে প্রবাহিত হচ্ছে- এমন খবর পাওয়া যায়নি। না পাওয়ারই কথা। কারণ পুঁজিবাদ উৎপাদনশীলতায় আগ্রহ হারিয়েছে বহু আগে। যে রূপ এবং গতিতে এখন সে বিশ্ব শাসন করছে সেখানে কলকারখানা গুরুত্বহীন। এখন অনুৎপাদনশীল খাতের জয়জয়কার।
একটা দেশের কলকারখানা চালু থাকা মানে তার অর্থনৈতিক প্রবাহে স্বাভাবিক গতি থাকা, যা সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্য ধরে রাখার পূর্বশর্ত। পোশাক কারখানা নিয়ে দেশে যা হচ্ছে পাটকল নিয়েও তা হয়েছিল। আমাদের পাটকল বার বার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। আদমজী পাটকল আবার চালুর পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে সে সময়ের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের শর্তের কাছে নতিস্বীকার করে পূর্ববর্তী বিএনপি সরকার আদমজী বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের শর্ত এখন আর কার্যকর নয় এবং দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও পাটের চাহিদা বাড়ছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চায় সরকার।’ বলার অপেক্ষা রাখে না সে সম্ভাবনাকে সরকার কাজে লাগাতে পারেনি। পুঁজিবাদের বর্তমান ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয় সে কথা আগেই বলেছি।
উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের বেকার হয়ে অনিশ্চিত পথ পাড়ি দেয়ার প্রভাব শুধু তার একার জীবনে নয়, সমাজে সার্বিক জীবনযাত্রাতেই পড়ে। কারখানায় কাজ করা শ্রমিকের আত্মবিশ্বাস যে সংস্কৃতি তৈরি করে বেকার ভবঘুরে জীবন তো তা পারেই না, তথাকথিত ক্ষুদ্র ঋণে যাদের জীবন চলে তাদের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতার বিচরণের গন্ডি তার গ্রাম, বড়জোর ইউনিয়ন পর্যন্ত আর কারখানা শ্রমিককে সমাজের সঙ্গে অনেক বেশি আন্তঃসম্পর্কে (Interaction) যেতে হয়। শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্কের প্রয়োজনে অন্যান্য শিল্পায়ন জরুরী হয়ে পড়ে। অনেকেই জানেন দেশীয় প্রসাধনের বাজার ধরে রাখতে আমাদের পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। পোশাক শ্রমিকদের প্রয়োজনে আরও কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বহুজাতিক কোম্পানির দেশীয় দালালদের জন্য দেশীয় প্রোডাক্ট মার খাচ্ছে। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে দেশীয় পণ্য যেমন বিপর্যস্ত তেমনি বিপর্যস্ত শ্রমিক, কৃষকও। গরিব কৃষক আরও গরিব হতে হতে রাজপথে ছিন্নমূল। শ্রমিকও কারখানা থেকে উৎখাত হয়ে কৃষকের পরিণতি মেনেছে।
একজন দক্ষ শ্রমিক দেশের অমূল্য সম্পদ। হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিকের হাত নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিচরণ অবাধ করতে মূল ভূমিকায় ছিল জেনারেল শাসকরা। বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কারের অংশ হিসেবে সে সময় সরকারী মালিকানায় ছয় শ’ পঞ্চাশটি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয়েছিল। উনিশ শ’ বিরাশি সালের নবেম্বর থেকে উনিশ শ’ পঁচাশির জুলাই পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পঁয়ত্রিশটি পাটকল ঢালাওভাবে ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয়েছিল। প্রতিবাদে সে সময় সারাদেশে শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলনে নামে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কড়া নির্দেশ মেনে শ্রমিক আন্দোলন উপেক্ষা করে বিরাশি সালের তিরিশ নবেম্বর একদিনই সরকার দশটি এবং পরের মাসে আরও তেরোটি পাটকল বেসরকারী খাতে ছেড়ে দিয়েছিল। উনিশ শ’ পঁচানব্বই সাল পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা মেনে বাকি বারোটা পাটকল বেসরকারী খাতে ছাড়া হয়। এমন সব মালিকদের কাছে কলগুলো দেয়া হয়েছিল যাদের অনেকের শিল্প প্রতিষ্ঠান চালানোর কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। একসঙ্গে এতবড় বেসরকারীকরণ পৃথিবীতে এর আগে হয়নি।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা সরকারের পক্ষে এমন আত্মঘাতী কাজ করা সহজ। সে জন্যই আশির দশকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেনা শাসকদের ক্ষমতাসীন করে সেসব দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভাঙ্গার কাজ সুসম্পন্ন করা হয়েছে। কারখানা বন্ধ করে দেশী-বিদেশী বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের লুটেপুটে খাওয়ার অবাধ সুযোগ সরকারীভাবেই করা হয়েছিল। পরে ‘গণতন্ত্র’র মোড়ককে যতই বজ্র আঁটুনি দেয়ার চেষ্টা হোক শেষ পর্যন্ত তা ফসকা গেরো হতে বাধ্য হয়েছে। কারণ লুটপাটই ক্রমশ হয়ে ওঠে অর্থনীতির আসল চেহারা। একেই আদর্শায়িত করে বর্তমান অর্থনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থা। ক্যামোফ্লেজ দিয়ে তা যতই ঢেকে রাখার চেষ্টা হোক।
সুতরাং পাট ও পাটপণ্য নিয়ে নতুন করে আবার যেসব খবর গণমাধ্যমে আশার বাণীরূপে আবির্ভূত হচ্ছে তার পরিণতি আগের মতোই ক্ষণস্থায়ী বুদবুদ তুলে মিলিয়ে যাওয়া ছাড়া ব্যতিক্রম কিছু যে হবে না তা বোঝার জন্য কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
সম্পাদনায়
ফকির শহিদুল ইসলাম