চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ বন্যায় এবার আউশ, আমন ও আমনের বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসলের ৮০ হাজার ৫৮৫ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণও ৯০ হাজার হেক্টরের বেশি। সারাদেশে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে শতকরায় সাড়ে আট ভাগের ওপরে। এতে ৬ লাখ ৫৩ হাজার কৃষকের ১ হাজার ১৫৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বন্যার এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রণোদনা বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবশ্যই প্রণোদনা বাড়ানো হবে। যেসব এলাকায় কৃষক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা বিনামূল্যে বীজ, সার ও বিভিন্ন উপকরণ দেবো।’
ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মীর নূরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যায় কোনো জেলায় ফসলের বেশি ক্ষতি হয়েছে, কোন জেলায় ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে। এবারের বন্যায় ৬ লাখ ৫৩ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১৫৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা।’
মীর নূরুল আলম বলেন, ‘রোপা আমনের বীজতলা পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। আমরা এখন আপৎকালীন ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেখানে বিকল্প বীজতলা গড়ে তোলা যাবে, সেখানে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের স্বল্পমেয়াদি বিকল্প ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পানি সরে যাওয়ার পরে যেখানে মাশকলাই চাষ করা যাবে, সেখানে বিনামূল্যে মাশকলাইয়ের বীজ দেওয়া হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এর ফলে মারাত্মক কোনো বিপর্যয় আসবে, এমন আশঙ্কা নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় দেশের ৩১ জেলায় বিভিন্ন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিছু ফসলের আংশিক ক্ষতি হলেও কোনো কোনো ফসলের জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে দণ্ডায়মান বিভিন্ন ফসলের পরিমাণ ১১ লাখ ৬৫ হাজার ১০ হেক্টর। এর মধ্যে ৮০ হাজার ৫৮৫ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৯১ হাজার ৪৭৪ হেক্টর ফসলি জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৯ হেক্টর ফসলি জমি। শতকরা হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৮ ভাগের বেশি।
এবারের বন্যায় দেশের ৩১ জেলায় আউশ, আমন, আমনের বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন সবজি, পাট, পানবরজ, আখ, কলা ও মরিচ জাতীয় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিচিঙ্গা, করল্লা, চালকুমড়া, পটল, ঝিঙ্গা, কাকরোল, ঢেড়স ও শসা। বন্যায় সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, রাজশাহী, নাটোর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পাবনা, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোণা, নওগাঁ, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা আক্রান্ত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে আউশের ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫ হেক্টর জমির মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১ হাজার ৬২ হেক্টর জমি, আংশিক ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমির ফসলের। এতে দেশের শতকরা সাড়ে পাঁচ ভাগ আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে এ বছর ৯১ হাজার ৮৮৬ টন ধান কম উৎপাদনের শঙ্কা রয়েছে। ৯৭ হাজার ১৮৪ জন কৃষককে আর্থিক ক্ষতি গুনতে হবে ২৫২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এছাড়া রোপা আমনে ৪১ হাজার ৯৫১ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের পরিমাণ ২ শতাংশ। আর বোনা আমনের ক্ষতি হয়েছে ১৭ ভাগ।
অধিদফতর আরও বলছে, আমনের বীজতলার ৯ হাজার ৭৫ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ও ৭ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বীজতলা ক্ষতির শতকরা হার ১১ ভাগেরও বেশি। আর দণ্ডায়মান ১১ লাখ ৭ হাজার ৫৪৭ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজির মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮ হাজার ৪৬৮ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৪৫ হেক্টর জমির সবজি। সারাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত সবজির পরিমাণও ৮ ভাগের বেশি।
ক্ষতি হয়েছে পাট, পান বরজ, আখ, কলা ও মরিচেরও। বন্যায় দেশের শতকরা ৯ ভাগ পাটের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২২ লাখ ৭ হাজার ১৩৯ হেক্টর পাট ক্ষেতের মধ্যে ১৩ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমির পাট সম্পূর্ণ ও ৩১ হাজার ৬৬৩ হেক্টর জমির পাট আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পাটচাষীর সংখ্যা এক লাখের বেশি। আর বন্যায় পাটে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, সারাদেশে বন্যায় পান বরজের ক্ষতি এক ভাগের ওপরে, আখে ৮ ভাগ, কলায় ১১ ভাগ ও মরিচে ১০ ভাগের ওপরে।
ক্ষতি কাটিয়ে উঠা প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান সারাবংলাকে বলেন, বর্তমানে কৃষকের তালিকা তৈরি হচ্ছে, পানি নেমে যাওয়ার পর যেন কৃষকরা মাশকলাই চাষ করতে পারে, সেজন্য মাশকলাইয়ের বীজ দেওয়া হবে। এতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে গরুর খাদ্যের জোগানও হবে।
অধিদফতরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, আমনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারিভাবে বীজতলা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া কৃষকও অনেক সময় উঁচু জায়গায় বীজতলা তৈরি করে। বর্তমানে ভাসমান বীজতলা তৈরির পদ্ধতিও আছে। এছাড়া আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকের জন্য সার ও বীজসহ বিভিন্ন উপকরণে প্রণোদনা তো থাকবেই। ফলে বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠা অবশ্যই সম্ভব।