সাহেব আলী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। মুক্তযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য বানাতে গিয়ে প্রথম স্ত্রীর সংসার ভেঙে গেলেও ছাড়েননি ভাস্কর্য বানানোর কাজ।
নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করতে তিনি ৬৬টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য বানিয়েছেন। কোনো অনুদান নয়, নিজের বসত-ভিটা বিক্রি করে নিরক্ষর এই মানুষটি মহৎকর্ম সম্পাদন করেছেন। বাকি ৫টি ভাস্কর্য নির্মাণাধীন, প্রয়োজন অর্থ। সাহেব আলীর এ হস্তশিল্প দেখতে অগণিত মানুষের ভিড় জমে তার গ্রামের বাড়িতে।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুরের ৩নং ওয়ার্ডের অজপাড়া গায়ের মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে সাহেব আলী। দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ারা ও ছেলে হাসান, হোসেন, মেয়ে নিলীমা ও নিলুফাকে নিয়ে সাতান্ন বছরের কোঠায় দাঁড়িয়েছেন তিনি।
এক ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবন্ধী। ১৯৯৬ সালে মুন্সীগঞ্জের একটি চালের মিলে কর্মরত অবস্থায় সহকর্মী বীরাঙ্গনা রাহিমার কাছে একাত্তরের সমাজ-সভ্যতা বিবর্জিত কাহিনী শুনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য বানাতে উদ্বুদ্ধ হন তিনি।
পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে এক নীরব সংগ্রামের প্রয়াস করেন। কিন্তু তার এই ভিন্ন শিল্পায়নের রূপ দিতে বসত-ভিটা বিক্রি ছাড়াও প্রথম স্ত্রী হনুফা তাকে ছেড়ে যায়। তবুও তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ ত্যাগ করেননি।
কখনও অর্ধাহারে কখনও অনাহারে দিন পার করে ভাস্কর্য বানানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। জীবিকা নির্বাহের কাজ ফেলে ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে সাহেব আলীর পরিবার নিয়ে কষ্টে কাটাতে হয়েছে। বর্তমানে পুরনো টিন দিয়ে শেড বানিয়ে পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চরম শঙ্কায় থাকেন তারা। সরকারি অথবা কোনো দাতা সংস্থা শিল্পকর্মকে সহায়তা দিলে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার অজানা ইতিহাস, ঐতিহ্য ভালোভাবে তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে বলে দাবি তার।
সাহেব আলী আরও জানান, প্রথমে ভাস্কর্য বানানোর কাজ শুরু করলে সংসারের আয়-রোজগার বন্ধ হয়। প্রথম স্ত্রী হনুফা পাগল বলে তাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, বাড়ির অভিমুখে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের বিখ্যাত ব্যক্তি, স্বাধীনতার চিত্রপট এবং একাত্তরের অবিস্মরণীর তাৎপর্য নিয়ে ২০টি প্ল্যাকার্ড। এছাড়াও প্রদর্শন করা হয়েছে নাগরিক সচেতনতামূলক কিছু বাক্য।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩০ শতক জমির ১৭ শতক জমি ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দীর্ঘ এক বছর ধরে ৬৬টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে এনজিও থেকেও ঋণ নিতে হয়েছে। পুরনো টিনশেডে তৈরি দোচালা টিনের ঘরটুকু ছাড়া বাকি জায়গায় প্রদর্শন করা হয়েছে- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বজ্রমুষ্ঠি, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ আঙ্গুলে প্রদর্শন করা হয়েছে গোটা বাংলাদেশ, বীর যোদ্ধার পদদলিত (পাক বাহিনী) কাল নাগ, ১৫ আগস্টের ভয়াবহ বুলেট, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ৫২-এর ভাষা আন্দলোনসহ মোট ৬৬টি ভাস্কর্য।
নিরক্ষর এই মানুষের হাতের নিপুন ছোঁয়ায় যেন ফুটে উঠেছে গোটা বাঙালি জাতির কৃতিত্ব এবং স্বাধীনতার সেই রক্তস্নাত স্মৃতি। বালু আর সিমেন্ট মিশ্রণে তাক লাগিয়ে দিয়েছে গোটা এলাকায়। শুধু গ্রাম নয়, শহর থেকে অনেকেই দেখতে যান সাহেব আলীর নিজ হাতে গড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ ভাস্কর্যগুলো।