চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃবর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত গৌড় নগর ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যযুগীয় অন্যতম বৃহৎ নগরী। এটি বাংলার প্রাচীন রাজধানী। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এটি বাংলার রাজধানী ছিল। প্রাচীন এই গৌড় নগর লক্ষণাবতী নামেও পরিচিত। প্রাচীন এই দুর্গনগরীর অধিকাংশ পড়েছে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলায় এবং এর কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। শহরটির অবস্থান ছিল গঙ্গানদীর পূর্ব পাড়ে, রাজমহল থেকে ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে এবং মালদার ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে।
গৌড় নগরের সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচীন বহু ইতিহাস। তবে এর বেশিরভাগ অংশই ভারতে। আর বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে যে অংশটুকু পড়ে আছে এই নগরীর ,তার পুরোটাই প্রকৃতপক্ষে ধ্বংসাবশেষ। নকশার ভিত্তিতে বর্ণিত চতুর্দশ শতকের কোতোয়ালী ফটক ব্যতীত ১৩-১৪ শতকে নির্মিত স্থাপত্য শিল্পের অন্য কোনো নিদর্শন বর্তমানে নেই।
তবে জায়গাটি ঘিরে আছে পর্যটকদের আগ্রহ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ দেখতেও অনেকে ছুটে যায় জায়গাটিতে। তাছাড়া বেশ কিছু পুরনো নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন প্রাচীন এই নগরী ভ্রমণকালে।
ফুলওয়ারি দুর্গ:
ফুলওয়ারি দুর্গ বর্তমান গৌড় দুর্গের ধ্বংসাবশেষের দুই মাইল উত্তরে অবস্থিত। কারো কারো মতে, এটি একটি হিন্দু দুর্গ ছিল। যদিও কিছু কালো কষ্টি পাথরের প্রস্তর খণ্ড ছাড়া সে স্থানে অন্য কোনো মুসলিম আমলের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, দুর্গটি শাহ সুজা কর্তৃক ব্যবহৃত হতো।
চকচকে ইট, কাদা মাটির তৈরী পাইপের ভাঙা অংশ, খোদিত চীনামাটির বাসনের টুকরো এবং অমসৃণ মৃৎপাত্র সহ বেশ কিছু প্রাচীন সামগ্রী দেওয়ালবেষ্টিত দুর্গের ভেতরে পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, দুর্গটি পনেরো ও ষোল শতকের দিকে ব্যবহৃত হতো।
বড় সোনা মসজিদ:
সুলতানি বাংলার রাজধানী গৌড়ের সর্ববৃহৎ মসজিদ এটি এবং এটি বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের চরম উৎকর্ষের নিদর্শন। মসজিদটি সাধারণত ‘বারোদুয়ারী’ বা বারো দরজা বিশিষ্ট মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদটি ইটের গাঁথুনির উপর পাথরের আস্তরণে নির্মিত। সামনের ভাগে রয়েছে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বিস্তৃত বারান্দা, ১১টি প্রবেশপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ১টি করে প্রবেশপথ।
উত্তর ও দক্ষিণ দিকে অতিরিক্ত তিনটি করে প্রবেশপথ সহ মসজিদটি তিন আইল বিশিষ্ট। আয়তাকার পুরু স্তম্ভের উপর বসানো আছে মোট ৪৪টি গম্বুজ। বর্তমানে শুধু বারান্দার উপরের গম্বুজগুলো এবং মসজিদের পার্শ্বদেয়াল টিকে আছে।
ছোট সোনা মসজিদ:
সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন বলা হয় এই ছোট সোনা মসজিদকে। বিশাল এক দিঘির দক্ষিণ পাড়ের পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে এই মসজিদটির অবস্থান। মসজিদের কিছুদূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক কয়েক বছর আগে নির্মিত হয়েছে একটি আধুনিক দ্বিতল গেস্ট হাউস।
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত সুলতানি আমলের সৌধগুলোর মধ্যে ছোট সোনা মসজিদ সর্বোত্তম সংরক্ষিত নিদর্শন। যদিও মসজিদটির পুরনো ও প্রকৃত সৌন্দর্য আর অবশিষ্ট নেই। তবে সংরক্ষিত এই নিদর্শন দেখে পুরনো চিত্র অনেকটা আন্দাজ করে দেখে নেয়া যায়।
তাহখানা কমপ্লেক্স:
গৌড় নগরীর ফিরুজপুর এলাকায় একটি বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ভবন কাঠামোটি ঐতিহ্যগতভাবে ‘তাহখানা’ নামে পরিচিত। ভবনটির উত্তরপশ্চিমে আরও দুটি কাঠামো রয়েছে। একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এবং কিছুটা উত্তরে অবস্থিত অপরটি ভল্টেড বারান্দা ঘেরা একটি গম্বুজ সমাধি।
যেহেতু ভবনগুলো একই সময় এক বিশেষ উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল, সেহেতু সবগুলো ভবনকে একত্রে একটি একক ইউনিট বা একটি কমপ্লেক্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বর্তমানে সব কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত। তাহখানা কমপ্লেক্সটি সুলতানি যুগের নগরে মুগল রীতির স্থাপনা হিসেবেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এটি তার স্থাপত্যিক গুণের জন্যই গুরুত্ববহ। এ ধরনের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য বাংলায় প্রথম।
লুকোচুরি দরওয়াজা:
গৌড় নগর দুর্গের গুমতি গেট থেকে কিছুটা উত্তর দিকে অবস্থিত একটি মুগল স্থাপত্য এই ‘লুকোচুরি দরওয়াজা’। কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথটি চার কোণা কেন্দ্রিক খিলানযুক্ত ঈওয়ান রীতি অনুযায়ী নির্মিত। এর দুইটি পাশেই রয়েছে একই রকম খিলান প্রবেশপথ। প্রবেশপথটি ইট দ্বারা নির্মিত এবং আয়তাকার।
এটি উচ্চতায় তিন তলা বিশিষ্ট। দ্বিতীয় তলায় নিচের তলার মত একই রকম প্রবেশপথ রয়েছে। উপরে সমান ছাদ, যা নক্করখানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানকার ছাদ থেকে নগর দুর্গে গভর্নরের প্রবেশ ও প্রস্থানের ঘোষণা দেওয়া হতো।
ছোট সাগর দীঘি:
নামে সাগর ও দীঘি দুইটি শব্দ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো সাগর কিংবা দীঘি নয়। এটি মূলত একটি বড় পুকুর যা ‘ছোট সাগর দীঘি’ নামে পরিচিত। গৌড় নগরের দক্ষিণ দেওয়ালের পেছনে বেলবারি মাদ্রাসার পূর্ব দিকে ‘ছোট সাগর দিঘি’ নামে এই বড় পুকুরটির অবস্থান। এই বড় পুকুরটি নগরের বিভিন্ন এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অাঁকাবাঁকা খালের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। যে কেউ এখনো গঙ্গার দিকে দুইটি খালের সমান্তরাল প্রবাহ দেখতে পাবেন।
গুণমন্ত মসজিদ:
ভাগীরথী (পুরনো গঙ্গা) নদীর তীরে মাহদিপুর গ্রামে অবস্থিত গুণমন্ত মসজিদ। গৌড় নগর দুর্গ থেকে ঠিক ১ কিলোমিটার দক্ষিণে মসজিদটির অবস্থান। গুণমন্ত মসজিদের নির্মাণকাল নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে মাহদিপুরে একটি অস্থায়ী মসজিদের বাইরে বর্তমানে ফতেহ শাহর আমলের একটি লম্বা শিলা লিপির ফলক পড়ে রয়েছে, যেটিতে ৮৮৯ হিজরির উল্লেখ আছে।
বলা হয়, গ্রামটির দক্ষিণের একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ থেকে একজন হিন্দু ওই শিলা লিপিটি এনেছিলেন। যেহেতু লিপিটির প্রাপ্তিস্থান গুণমন্ত মসজিদ থেকে দূরে নয়, তাই অনেকে এটিকে গুণমন্ত মসজিদের লিপিফলক বলে মনে করেন।