শেখ মাহতাব হোসেন :: বিএ পাশ করে চাকুরির পেছনে ঘুরে হতাশ, অন্যের ঘেরে ৪ বছর ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন। তারপর ১০ বছর মাছ কোম্পানিতে চাকুরি করেন কিন্তু কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিলেন না। পিপাসা ছিলো নিজে কিছু করার, স্বাবলম্বী হওয়ার। স্বপ্ন পূরণের জন্য অবশেষে যোগাযোগ করেন উপজেলা মৎস্য দপ্তরে।
উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে পরামর্শ নেন।এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এই ছিল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরখালী ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামের সমর দাশের বেকার যুবক থেকে সফল বাগদা চিংড়ি চাষি হয়ে ওঠার গল্প। তার সাফল্যগাথার গল্প শুনে এখন আশপাশের গ্রামের যুবকরাও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন।
প্রতিদিনই কেউ না কেউ যাচ্ছেন সমর দাশের চিংড়ি প্রকল্প দেখতে, নাম অতিথি একুয়াকালচার।
কেবল গ্রামের লোকজনই নন, বিভিন্ন সময় উর্দ্ধতন মৎস্য কর্মকর্তারাও যাচ্ছেন বাগদা চিংড়ির খামার দেখতে।
সমর দাশ ১১ টি পুকুরে বাগদা চাষ করেন যার আয়তন ১.৫ হেক্টর ৷ পুকুরগুলো যেনো কাঁচা সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে।
আর হবেই বা না কেনো।
পুকুরে বাগদা চিংড়ি চাষ করে অভাবনীয় সফলতা পাওয়া সমরকে এখন গাঁয়ের লোক এক নামেই চেনেন।
আধুনিক পদ্ধতিতে তিনি বাগদা চাষ শুরু করেন। এবছর তিনি ৭ টি পুকুরে চাষের জন্য প্রস্তুত করেন। যার মধ্যে ৬ টি পুকুর ৩৫০০ বর্গমিটার করে ও ১ টি পুকুর ২০০০ বর্গমিটার। প্রতি বর্গমিটারে তিনি ভাইরাস মুক্ত এসপিএফ ২৫ টি রেনু মজুদ করেন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ২০ মে. টন।
সম্প্রতি ইএমএস নামক মড়কে ৪৫-৫০ দিন বয়সের চিংড়ি মরে যাওয়ার ইতিহাস পাল্টিয়ে চিংড়িগুলো ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে ওঠে। এর পরেই বুকে সাহস জাগে সমরের। গত বছর একই জলাশয় হতে তিনি উৎপাদন করেন ১৮ মে. টন বাগদা।
সমর দাশ বলেন, মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শে চিংড়ির সঙ্গে তিনি মিশ্রভাবে ভাঙ্গান, পারশিয়া ও কার্পজাতীয় মাছ চাষ করেন। এতে চিংড়ির মড়কের সম্ভবনা কম থাকে। কারন কোন কারনে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হলেও আক্রান্ত মাছকে কার্প মাছে খেয়ে ফেলে। এতে অন্য চিংড়ি সংক্রমনের হাত থেকে রেহাই পায়। সরেজমিনে দেখা যায় চিংড়ির অক্সিজেন সাপ্লাই নিশ্চিত করতে তিনি প্রত্যেকটি ঘেরে ব্যবহার করছেন এ্যারেটর। প্রতিদিন পানির অক্সিজেন, লবণাক্ততা ও পিএইচ পরিমাপ করা হয়। রেনু মজুদকালীন লবণাক্ততা ১২ পিপিটির বেশি থাকে, পরবর্তীতে তা ৫ পিপিটিতে নেমে আসে। পানির পিএইচ থাকে ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে।
সমর দাশের খামারের সবচেয়ে বড় একটি বিশেষ দিক হলো তিনি বাণিজ্যিক ভাবে অবসিজন তরমুজ, অবসিজন শিম, অবসিজন টমেটো, পেঁপে, করলা, বারমাশি লেবু, মরিচ, শসা, বরবটি, ঝিঙে, লাউ, পোল্লা, চিচিঙ্গা, জাত কুমড়া, মিস্টি কুমড়া, ঢ়েড়স, কচুরমুখী, ওলকচু, মেটে আলু প্রভৃতি সবজি চাষ করেন। সবজি থেকে অতিরিক্ত ১০ লক্ষ টাকা লাভ হবে বলে তিনি জানান।
মাত্র ৬৬ দিনের নিবিড় পরিচর্যায় এখন একেকটি পিএল চিংড়ি ১৫ গ্রাম ওজন হয়েছে। চিংড়ির খাবার, বিদ্যুৎ খরচ, ওষুধ ও রক্ষণাবেক্ষণ দিয়ে তার ১ কোটি টাকা খরচ হবে। চিংড়ি বিক্রি করলে প্রায় এক কোটি টাকা লাভ হবে বলে জানান সমর দাশ।
তিনি আরো বলেন, তার চিংড়ি পুকুর দেখতে এখন আশপাশের গ্রাম ও দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসছেন। এতে ভালোই লাগে তার। কখনও বিরক্ত হন না।
সরকার এগিয়ে আসলে তিনি সহ আরও অনেকের বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচবে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেলে স্বপ্নের পালে বাতাস লাগবে অনেকের।
সমর দাশের খামারে বর্তমান ১৩ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। যাদের বেতন বাবদ প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুবকর সিদ্দিক বলেন, সমর দাশ অত্যান্ত দক্ষ একজন চিংড়ি চাষি। ২০২০ সালে তিনি খামারটি শুরু করেন। মৎস্য দপ্তর হতে তাকে সকল প্রকার কারিগরী পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন অন্য বাগদা চাষিদের জন্য সমর দাশ অনুকরণীয়। তবে সমর যদি ব্যাংকে ঋণের আবেদন করেন তাহলে তারা শতভাগ সুপারিশ করে তা পাস করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।