চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিট বুকিং দিয়ে সেটি ক্যানসেল (বাতিল) করলেও অর্থ উপার্জন সম্ভব! ভুয়া টিকিট বুকিং দিয়ে আবার সেটি বাতিল করলে বিমানের এক পয়সাও লাভ হয় না। কিন্তু এ বুকিং বাতিল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চারটি গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) কোম্পানি। পৃথিবীর অন্য কোনো এয়ারলাইন্সে এ ধরনের অসম চুক্তি না থাকলেও বিমানে কয়েক যুগ ধরে চলছে এমন লুটের ধারা।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিট প্রাপ্তি নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ বছরে বিমানের ৪৫ হাজার টিকিট হরিলুট করা হয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ ভাগ কমিশনে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এসব টিকিট ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়। টিকিটগুলো নিজেদের নামে নিলেও পরবর্তীতে তা বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন তারা।
এমন অভিযোগের মধ্যে বিমানের টিকিট বুকিং বাতিলেও বাণিজ্যের অভিযোগ এলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিমানের সঙ্গে চার জিডিএসের অসম চুক্তির কারণে প্রতিটি টিকিট বাতিল বুকিং বাবদ জিডিএসকে দশমিক তিন পাঁচ থেকে দশমিক চার শূন্য (০.৩৫-০.৪০) ডলার পরিশোধ করা হচ্ছে। এমন চুক্তির সুযোগ নিয়ে কিছু এজেন্টের সহযোগিতায় জিডিএসগুলো বিমান থেকে কোটি কোটি টাকা বিল নিয়ে যাচ্ছে। আর বুঝে বা না বুঝে প্রতি বছর এ অসম চুক্তি নবায়নে স্বাক্ষর করেছেন বিমানের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক পরিচালকরা।
সম্প্রতি বিমানের সঙ্গে জিডিএসের অসম চুক্তির বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর এর রহস্য উদঘাটনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ লুটপাটের চিত্র উঠে আসে।
চারটি জিডিএস কোম্পানির মাধ্যমে বিমানের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের কারণ অনুসন্ধান করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও এজেন্সি চিহ্নিতকরণ এবং আর্থিক ক্ষতি নিরূপণে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে জিডিএস কোম্পানিসহ জড়িত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির আহ্বায়ক হলেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতিকুল ইসলাম। অন্য সদস্যরা হলেন- মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব যতন মার্মা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সহকারী ব্যবস্থাপক (রেভিনিউ ইন্ট্রিগ্রিটি) আক্তারুজ্জামান মজুমদার।
বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিও গতকাল বুধবার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বুকিং দিয়ে সেই বুকিং বাতিল করে চারটি গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) কোম্পানি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে এক বছরে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
বিমানের একটি উচ্চপর্যায়ের সিন্ডিকেট বা সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের যোগসাজশে এ অসম চুক্তি করা হয়। অসম এ চুক্তি করে টাকা হাতিয়ে নেয়া জিডিএস প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- অ্যামাডিউস, অ্যাবাকাস, গ্যালিলিও ও সাবরি। ভয়াবহ এ লুটপাটের সহযোগী বিমানেরই তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক ট্রাভেল এজেন্ট। টিকিট বিক্রির চেয়ে বুকিং ক্যানসেল বাণিজ্যে বেশি মনোযোগী তারা।
এ বিষয়ে বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) ইনামুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, অনিয়ম ও অসঙ্গতি দূর করতে আমরা তৎপর। তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবতাকে সামনে রেখে, বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের পরামর্শের আলোকে কাজ হচ্ছে।
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত দশ মাসে টিকিট বুকিং বাতিলের জন্য চারটি জিডিএস কোম্পানিকে ৯৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার ৮৮৮ টাকা প্রদান করে বিমান বাংলাদেশ। যার ৭০ থেকে ৯০ ভাগ বুকিং ছিল ভুয়া। উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্ধারিত দশমিক তিন পাঁচ থেকে দশমিক চার শূন্য (০.৩৫-০.৪০) ডলার হারে বাণিজ্য করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
ওই সময়ে পাঁচটি আউট স্টেশনের ২২ এজেন্ট ৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল করেছে। এছাড়া সাত দেশের ৩১ এজেন্ট ৭৫ শতাংশ টিকিট বুকিং বাতিল করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি এজেন্টদের ‘ট্রাভেল এজেন্ট লাইসেন্স’ বাতিলের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে জানান, চুক্তিতে বুকিং বাতিলের জন্য অর্থ দেয়ার মতো আত্মঘাতী কথাগুলোর উল্লেখ না থাকলে বিমানকে এত বড় মাসুল গুণতে হতো না। বাংলাদেশে তো নয়ই, বিশ্বের আর কোনো এয়ারলাইন্সে এ ধরনের আত্মঘাতী চুক্তি আছে কি-না, সন্দেহ রয়েছে।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ক্যাপ্টেন ফারহাত হাসান জামিল বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশের বিষয়ে বিমান পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে অনিয়ম ও অসঙ্গতি দূর করার বিষয়ে বিমান ম্যনেজমেন্ট দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।