চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃবিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেয়ার ঘটনার কথা বিভিন্ন সময়ে উঠে আসলেও সব প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।র্যাগের নামে ‘বড় ভাইয়েরা’ যা করেছে সেটি শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাবে যে কারো। ভবিষ্যতে নিজের সন্তানকে কোনো অভিভাবক বুয়েটে পড়াশোনার জন্য পাঠাবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত নিতে একশবার ভাববেন।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নিহত বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন শিক্ষার্থী। র্যাগের নামে পর্নো মুভি দেখিয়ে সে অনুযায়ী অভিনয় করানো হতো তাদের। র্যাগের অত্যাচর সহ্য করতে না পেরে অনেকে বুয়েট ছাড়ারও চিন্তা করেছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের মন্তব্য এমন, ‘বুয়েটকে বাইরে দেখে অনেক ভালো লাগত, ভিতরে এতো খারাপ!’
শিক্ষার্থীদের ভাষায় র্যাগের ভয়াবহতা :
পর্নো দেখিয়ে আইটেম গানে নাচানো :
আমি রফিক (ছদ্মনাম)
এক বুধবার রাতে আমাকেসহ মোট পাচঁজনকে ‘আউলা’র ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অপরাধ ছিল ভাইরা আমাদের গণরুম থেকে র্যান্ডমলি দুই/তিনজনকে পাঠায় দিতে বলছিল। ভয়ে কেউ প্রথমে যাইনি। তিনজন ভাই এসে র্যান্ডমলি আমাদের পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায়।
ছাদে আমাদের পাঁচজনকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ম্যানার, বুয়েট পলিটিক্স কেন সবার থেকে আলাদা সেটা শেখায়। আমাকে একজন ভাই টিশার্ট ধরে ধাক্কাধাক্কি করে গালে পাঁচটা (আস্তে, বাট চড় তো চড়ই) চড় মেরেছিলো। আর প্রায় ঘণ্টার মতো একপায়ে দাঁড় করে রেখেছিলো। সেখানে আরেক ভাই বলেছিলো, একটু পর পর পা চেঞ্জ করতে পারিস। বাকিদেরকে অনেক হেনস্থা করা হয়।
যাই হোক, এই দেড়ঘণ্টা পর পুরো NTS (আউলার একটা গণরুম) কে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখানে কী হয় আশা করি বাকি যারা ছিল বলবে।
হলের প্রথমদিকে হলের পপুলার দুই ভাই পালা করে করে রুমে নিয়ে গিয়ে র্যাগ দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে আমাকে আর মাকসুদকে (CSE) রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে দিয়ে মাকসুদকে (ছদ্মনাম) এবং মাকসুদকে দিয়ে আমাকে মারা হয়। আমাদের ভাইদের সাথে জোর করে পর্নো দেখানো হয় এবং আইটেম সংয়ের সাথে আমাদের নাচানো হয়।
আমি ভাইদের মেন্টাল টর্চারগুলো নিতে পারি নি। এ রকম অনেক ঘটনা সবার সাথে প্রায় ঘটতো। ১৮ ব্যাচের সবার সাথেই এরকম কম-বেশি হয়েছে। তারা হয়তো মজা করে করেছে, বাট তাদের মজাগুলো সবাই নিতে পারেনি। অনেক রাতে বাথরুমে কান্নাকাটি করেছি। প্রথমে আমি অনেক পড়ালেখা করলেও এই ভাইদের জন্য পড়ালেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি।
আমি প্রথম দিকে অনেক একটিভ, হাসিখুশি ছিলাম; বুয়েটে কয়েকদিন থাকার পরের অবস্থা ব্যাচমেটকে/ক্লোজ ভাইদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারা যাবে। বুয়েটকে বাইরে দেখে অনেক ভালো লাগত, ভিতরে এতো খারাপ অবস্থা ভর্তি পরীক্ষায় আর দুইটা অঙ্ক ভুল করলে কোনোদিন জানতাম না।
সালাম না দেয়ায় স্টাম্প দিয়ে পিটানো হয়:
আমরা রশিদ হল ১৭ সবে মাত্র এক-দুইতে উঠেছি। বুধবার অথবা বৃহস্পতিবার (এক্সাক্টলি মনে নাই) রাতে কমন রুমে ডাকা হলো। এর আগে সাধারণত বুধবার রাতে ডেকে র্যাগের নামে ধমক, ব্যাচমেটকে দিয়ে থাপ্পর এবং মজা নেওয়া হত। কিন্তু ওইদিন রাত্রে আমাদের একজন ব্যাচমেটকে দিয়েই স্টাম্প আনানো হল। তারপর একে একে স্টাম্প দিয়ে পিটানো শুরু করল। প্রথমে একজনকে জিজ্ঞেস করলো সালাম দেয়নি কেন? সালাম না দেয়ার কারণে তাকে ১৬ ব্যাচের রামকৃষ্ণ তন্ময় তাকে ৫ মিনিট পিটায়। তারপর একজন কেন অ্যাডমিশন রিলেটেড পেইজে মোটিভেশনাল পোস্ট দেয় সেজন্য তাকেও পেটানো হল। তারপর কয়েকজনকে এভাবে পিটানোর পরে রামকৃষ্ণ তন্ময় ক্লান্ত হয়ে পরে, পেটানোর দায়িত্ব নেয় ১৬ ব্যাচের মোহাইমিনুল সৌরভ। তারপর ৫/৬ জন করে এককাতারে দাঁড় করিয়ে পেটায়।
একজন কেন মেয়ে ক্লাসমেট নিয়ে ঘুরলো সেই জন্যও তাকে মারা হল। তারপর আরেকজন কেন ভাই এর সিলেক্ট করা রুমে ওঠে নাই, সেজন্যও তাকে মারা হয়। তাকে পায়ে ও পাছায় অন্তত ৪০টি আঘাত করা হয়। এভাবে প্রায় ২০/২৫ জনকে দুইজন মিলে মারে। এর মধ্যে কয়েকজনকে কোনো কারণ ছাড়া মারা হয়। তারপর এভাবে ৩/৪ ঘণ্টার অমানবিক নির্যাতন শেষে আমাদের ছাড়া হয়। এই নির্যাতনের পরে অনেকেই হাটতে পারছিলো না।
অত্যাচারে বুয়েট ছাড়তে চেয়েছিলেন একজন
১৫ ব্যাচের আমার একজন প্রিয় বড় ভাই আছেন। আমাকে যখন আউলার এক্সটেনশনে র্যাগ দেয়, তখন ইনি কিছুই করেন নাই তেমন। বরং র্যাগ শেষে ভাই নিজেও অনেক দু:খ করেছিলেন। সেই ভাই অনুতপ্ত। কিন্তু যে তিনজন আমাকে ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আরো দশ/বারোজন দিলে র্যাগ দিছে, পুরো ফার্স্ট ইয়ার আমার লাইফ হেল করে ফেলেছিলো। তারা এখন সাধু সেজে বেড়াচ্ছে। এতোই মানসিক প্রেশারে ছিলাম যে, সবসময় ভয় হতো এই বুঝি আবার আমার দোষ ধরে। আবার না র্যাগ খাই। এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, কাঁদতে কাঁদতে এদেরকে বলেছিলাম, ‘বুয়েটেই আর থাকবো না’।
‘আউলা ১৬’ এর প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি ছিলো কমন। এ আমাকে ফার্স্ট ইয়ারে অসহায় বানিয়েছিলো। আমি হল পর্যন্ত ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকায় থাকার মতো কোনো জায়গা বা আত্মীয় নেই। আবার মেসে থাকবো, সেই টাকা কোথায় আমার। আমি গ্রামের ছেলে অনেক কষ্ট, স্ট্রাগল করে এই বুয়েটে এসেছিলাম। আর এসে এসব হারামিদের হাতে পড়েছিলাম। সে সময়ের মানসিক টর্চার আমি সারাজীবনেও ভুলতে পারবো না। কতটা অসহায় বানিয়েছিলো এই আমাকে। আমাকে যখনই দেখতো, তখনই কোনো না কোনো দোষ ধরে যে র্যাগ দিতো। সারাজীবনেও এই হারামিকে ভুলতে পারবো না।
র্যাগের নামে হস্তমৈথুনের অভিনয় করানো হতো:
‘আমাদের হলে শুরু থেকে প্রতিটি বুধবার রাত থেকেই আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছিলো। কারণ এইদিন আসলেই আমাদের ডাক পড়তো র্যাগ খাবার জন্য। বিশ্বাস করেন, আমাদের র্যাগ মোটেই কোনো সুন্দর কিছু ছিল না।
আমাদের শুরু থেকেই হাওয়াই চেয়ার বানানো হতো, অসংখ্যবার কান ধরে উঠবস করানো হতো, বুকডন দেওয়ানো হতো। এগুলো তাও আমরা মেনে নিতাম। আমাদের পর্নো দেখানো হতো জোর করে এবং বলা হতো আরেক ক্লাসমেটকে এভাবে করে দেখাতে। পর্নোতে যে রকম শব্দ হয় ঠিক সে রকম করতে বলা হতো আমাদের। আমাদের পর্নো দেখায় হস্ত মৈথুনের অভিনয় করানো হতো। চুপচাপ করলেও হতো না, আমাদের ফিলিংস এনে শব্দ করতে বলা হতো। এ রকম না করলে আরো হুমকি করা হতো। ভাইরা মাঝে মাঝে বলতো কারো খারাপ লাগে কি না? খারাপ লাগে যদি বলতো কেউ তাকে আরো এক্সট্রিম আচরণ করা হতো।
আগস্ট মাসের শেষ দিকে একবার আমাদের সবাইকে ডাকা হয় এবং আমাদের কয়েকজনকে রেখে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর আমাদের ছাদে তোলা হয়। ছাদে ৭ জন ভাই ছিল ১৭ ব্যাচের। তারা আমাদের সবাইকে অনেক অনেক লেম রিজন দেখিয়ে মারতেই থাকে।
একজনকে মারে এই কারণে যে, সে ভাইদের না বলে হলের বাইরে কি করতে গিয়েছিল? সে যখন বলে মা-বাবা এসেছিল তখনও তাকে মারতেই থাকে স্ট্যাম্প দিয়ে। সবাই ঘুরে ফিরে মারে তাকে। আরেকজন ভাইদের না বলে টিউশনিতে যাওয়ায় তাকে মারতে থাকে অমানবিকভাবে।
একজন তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে যাওয়ায় মার খায়। আর ভাইকে দেখার পরও সালাম দেয় নাই কেন এজন্য আরো মার খায়। পাশাপাশি এটার জন্যও মার খায় কারণ তার হাঁটার স্টাইল ভাইদের পছন্দ হয় নাই।
আমাকে মারার ফার্স্ট রিজন হচ্ছে ভাইদের না বলে মুভি দেখতে যাওয়া। আমি ‘হবস এন্ড শ’ দেখছি শুনে বলে এটা তো ফালতু মুভি, এটার জন্যও আমারে মারে। একবার র্যাগ দেবার সময় ভাইরা আমাদের এক ক্লাসমেটকে মারতে বলে, আমি মারছিলাম। এটার জন্যও আমাকে মারা হয়, সিএসবিতে আমি ভাইদের না বলে কেন পোস্ট দিছি সেজন্যও মারা হয়।
আমাকে সবাই মারছে যারা ছিল। আমি আগে থেকেই এক্সারসাইজ করি বলে শরীর পেটানো ছিল। ভাইরা তারপর বলে, জীবনে তো এক্সারসাইজ করা শরীরে মারি নাই, আরেকটু মেরে নিই। এটা বলে সব বিচার শেষ হবার পরও আমাকে মারতে থাকে। আমি নিজে জানি আমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। স্ট্যাম্প দিয়ে মার খেতে খেতে আমি ব্যাথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। খালি ভাবছিলাম ফেরত যেতে পারব তো আজ? খুব কষ্ট হয়েছিল। শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট বেশি ছিল৷ প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা আমাদের আটকে রেখে মারে ২০১৭ এর ব্যাচের এরা।
আমাকে ভাইরা র্যাগ দিতে গেলেই বলছে সবসময় বুকডন দিতে। আমার হাত ভাঙা কিন্তু তবুও দিতে বাধ্য করছে। আসলে আমার কারো উপরই ক্ষোভ নাই, নইলে নাম উল্লেখ করতাম। আমি পাপীদের না, পাপকে ঘৃণা করি। আমি স্রেফ চাই এরা যেন সুবোধকে ফেরত পায়, বুয়েটে শান্তি আসলেই আমি খুশি।এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর র্যাগের বিরুদ্ধে ফুঁসে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। দাবি উঠছে আইন করে ছাত্র নির্যাতনমূলক র্যাগ প্রথা নিষিদ্ধ করার।