উন্মুক্ত স্থানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাধা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। তাই ডিজিটালি আয়োজিত হয়েছে ছায়ানটের বর্ষবরণ। সেখান থেকে এলো মঙ্গলবার্তা, সুন্দর আগামীর কামনা।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৭টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় বর্ষবরণের এই আয়োজন। অনুষ্ঠানটি সাজানো হয় রমনার বটমূলের পুরোনো আয়োজন ও নতুন রেকর্ড করা পরিবেশনার সমন্বয়ে।
গান, আবৃত্তিতে মানুষের মঙ্গল কামনা ছাড়াও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ছিল দেশাত্নবোধক গানের পরিবেশনা।
এ নিয়ে রমনা বটমূলের আয়োজন টানা দ্বিতীয়বার বাতিল করা হলো। গতবারও ডিজিটাল মাধ্যমে বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়।
ইউসুফ আলী খানের সরোদ বাদনে শুরু হয় অনুষ্ঠান। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পূর্বগগনভাগে দীপ্ত হইল সুপ্রভাত’ সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। আব্দুল ওয়াদুদ ও সেঁজুতি বড়ুয়া একক কণ্ঠে পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘অন্ধকারের উৎস হতে’ ও ‘আমি ভয় করব না’। ছোটদের দল সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করে কাজী নজরুল ইসলামের ‘এলো এলো রে বৈশাখী ঝড়’। পরে একক কণ্ঠে খায়রুল আনাম শাকিল গেয়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘গগন প্রলয় মেঘের ভেলা’ এবং ফারহানা আক্তার শার্লি গেয়ে শোনান মো. মনিরুজ্জামানের ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’।
ভাস্বর বন্দ্যেবাধ্যায় আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতাটি। নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি গেয়ে শোনান জয়দেব সেনের ‘এই বাংলার মাটিতে মাগো’, রেজাউল করিম গেয়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘স্বদেশ আমার জানি না তোমার’।
অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে সম্মেলন কণ্ঠে গাওয়া হয় লালন শাহ রচিত ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত’, আবুল কালাম আজাদ গেয়ে শোনান শাহ আবদুল করিমের ‘জীবন আমার ধন্য যে হয়’ এবং সম্মেলক কণ্ঠে সলিল চৌধুরীর ‘ও আলোর পথযাত্রী’।
ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুনের বক্তব্য এবং সবশেষে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
এ সময় সনজীদা খাতুন বলেন, “আমরা আশা করছি, অন্ধকারের উৎস থেকে আলো উৎসারিত হবেই। নতুন বছর বয়ে আনবে সর্বজনের জন্য মঙ্গলবার্তা। আলো আসবেই।”
আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, নববর্ষের আয়োজন সর্ব ধর্মের বাঙালিকে ঐক্যসূত্রে যুক্ত করে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অসংখ্য প্রাণের আত্মদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সংস্কৃতির যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন হয়েছে বলা যায়।”
“অর্ধশতবর্ষ পরে ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে ওঠা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ঈর্ষনীয় সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি আমাদের আশাবাদী করে তোলে।”
ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গে সনজীদা খাতুন বলেন, “কিন্তু ধর্মের মর্মবাণীকে উপেক্ষা করে নতুন অবয়বে উত্থিত ধর্মবিদ্বেষ সম্প্রীতির সমাজকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। লোভের বিস্তার বৈষম্য সৃষ্টি করছে। খণ্ডবিচ্ছিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে সামাজিক অবক্ষয়ের। দেশের অগ্রযাত্রাকে অক্ষুণ্ণ রেখে নেতিবাচক প্রবণতাকে রোধ করবার জন্যে অতীতের মতো বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার প্রসার, মানবিক সমাজ গঠনের এক অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে।”
সবশেষে বলেন, “আমরা আশা করছি অন্ধকারের উৎস থেকে আলো উৎসারিত হবে। নতুন বছর বয়ে আনবে সর্বজনের জন্য মঙ্গলবার্তা। আলো আসবেই। শুভ নববর্ষ।”
মহামারি পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আগেই জনসমাগম করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন না করে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর পহেলা বৈশাখেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে কঠোর বিধি-নিষেধ।
১৯৬৭ সাল থেকে নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলে ছায়ানট বর্ষবরণের আয়োজন করে আসছে। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি যখন তাদের অন্যায়-অন্যায্য শাসনকে ন্যায্যতা দিতে ধর্ম ব্যবহার করতে চেয়েছে,তখন এ ভূখণ্ডের বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছে তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।
ষাটের দশকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির আত্মপরিচয়ের আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। সেই একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রেরণা জুগিয়েছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামেও। স্বাধীনতার পর পয়লা বৈশাখ পেল সাধারণ ছুটির দিনের মর্যাদা। ধীরে ধীরে বাংলা নববর্ষ হয়ে উঠল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উৎসবের দিন।