২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের ঋতুরাণী বসন্তের অগ্নিঝরা দিনটি বাঙালী জাতির এক অনবদ্য চিরস্মরণীয় দিন। এ বছর দিবসটির আরও ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত ‘মুজিব বর্ষ’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ১০২তম জন্মবার্ষিকী এবং মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে মহান এই অবিস্মরণীয় নেতা, জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থক, বিদেশি বন্ধুসহ সকলস্তরের জনগণকে, যাঁরা আমাদের অধিকার আদায় ও মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের স্মৃতির প্রতি হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা, অকৃত্রিম ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও সমবেদনা।
ব্র্রিটিশ উপনিবেসিক শাসন অবসানের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ‘৬৬ এর ৬ দফা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান ও ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সংগ্রামী সুদক্ষ নেতৃত্ব ও জয়ের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি ইউনেসকো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেখানে বঙ্গবন্ধু সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালী জাতির উদ্দেশ্যে দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। উক্ত কালজয়ী ঘোষণার মধ্যে লুকিয়ে ছিল ২৬ শে মার্চ (স্বাধীনতার ঘোষণা) ও পরবর্তী ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১-এ মহান বিজয় দিবসের শুভ সূচনা। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে স্বাধিকারের চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তা ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ ভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির ওপর শোষণ এবং ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকারের দাবিতে জেগে ওঠা নিরীহ বাঙালির ওপর ২৫ মার্চ রাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চালায় বর্বর গণহত্যা। ওই রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। যাহা পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সংগ্রামে রূপ নেয়।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালি মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণহীন নিরস্ত্র বাঙালিরা যেভাবে একটি সুশৃঙ্খল অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত বিরল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বিজয়। বাঙালি লাভ করে চিরকাঙ্খিত স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। সে রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দি করে রাখা হয়। সে সময় প্রহসনের বিচার করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্যোগও নেয় পাকিস্তানি শাসকরা। যদিও পরে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সেনাবাহিনীর একদল পথভ্রষ্ট, বিশ্বাসঘাতক সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে দেশের সবচেয়ে সুযোগ্য ও দক্ষ প্রধানমন্ত্রী।
ঐতিহাসিক এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর স্বপ্ন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা লক্ষ্য অনুযায়ী সোনার বাংলা আমরা গড়বোই। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শি নেতৃত্বে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা জেগে রইবো বঙ্গবন্ধু’র আদর্শ বুকে নিয়ে। জেগে থাকবে মানুষ- প্রজন্মের পর প্রজন্ম- তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। জাতির পিতার দেয়া পতাকা সমুন্নত থাকবে চিরদিন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর ও জাতির পিতার জন্ম শতবাষির্কীতে দেশ, গণতন্ত্র ও সরকারবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের চলমান উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই শুভক্ষণে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করার উদাত্ত আহবান জানাই।
আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। ঐতিহাসিক ৫১তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস অমর হোক।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।