মানব পাচারের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক অবস্থান জিরো টলারেন্স। গতানুগতিক কৌশলে পাচারে যুক্ত হলে সহজেই ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই নতুন কৌশল অবলম্বন করছে পাচারকারীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ফেসবুককে’ তারা পাচারের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। পাচারকারীরা তরুণী-কিশোরীদের সঙ্গে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছে। রিকোয়েস্ট গ্রহণের পর তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করছে। বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য একাধিকবার কিশোরী-তরুণীদের বাসায়ও যায়। এরপর পালিয়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বাসা থেকে বের করে আনে। পরে কৌশলে দেশের বাইরে পাচার করে দেয়া হচ্ছে ভিকটিমদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থলপথে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করা হচ্ছে। পাচারের পর র্ভিকটিমের ‘ফেসবুক’ অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়।
সম্প্রতি আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এক সদস্যের কিশোরী মেয়েকে পাচারের পর এই চক্রের সদস্য মো. আকাশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে দুই দফায় রিমান্ডেও নেয়। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সুমন নামে তার এক সহযোগীকেও। মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ-সুমন অভিনব কায়দায় মানব পাচারের বিষয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, কৌশলের অংশ হিসেবে বাসা থেকে বের করার কয়েকদিন আগে থেকেই ওইসব তরুণী-কিশোরীর মোবাইল ফোন বন্ধ রাখা হচ্ছে। বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোন বহন করতে দিচ্ছে না চক্রটি। কারণ, মোবাইল ফোন সঙ্গে থাকলে ভিকটিমের অবস্থান নির্ণয় করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলনামূলক সহজ হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পাচার চক্রের সদস্যের মোবাইল ফোনটিও (যে নম্বরটি পরিচিতরা জানে) রেখে যাওয়া হচ্ছে বাসায়। কৌশলের অংশ হিসেবে ওই নম্বরটি খোলা রাখা হচ্ছে। যখন বুঝতে পারছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তার আটক হওয়া সমূহ আশঙ্কা আছে, তখনই সব মোবাইল ফোন বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে চক্রের সদস্যরা। এ ধরনের একটি চক্রের হাতে সম্প্রতি পঞ্চম আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন উত্তরায় কর্মরত এক সদস্যের এসএসসি পাস করা কিশোরী পাচারের শিকার হয়েছে। ভিকটিম এপিবিএনের উত্তরায় সরকারি কোয়ার্টারে পরিবারের সঙ্গে থাকত।
পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত আকাশের বাবা আলাউদ্দিন তিনটি বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী লিপি বেগমের ছেলে আকাশ। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদরের কূলপদ্দিতে। কিন্তু সেখানে তার কোনো জায়গা-জমি নেই। আকাশ একজন বড় ধরনের প্রতারক। মানব পাচার ছাড়াও চাকরি দেয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাকে গ্রেফতার করার পর অনেক ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করেছেন। তার নামে আগের একাধিক মামলা আছে। সম্প্রতি দক্ষিণখান থানায়ও একটি মামলা হয়েছে। অনেক মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। প্রতারণাই তার মূল পেশা।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে জানান, পাচারের শিকার কিশোরী কাউকে কিছু না বলে ২২ নভেম্বর সকাল সোয়া ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কোথাও তার কোনো সন্ধান না পেয়ে তার বাবা ২৫ নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১১৭৩) করেন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে এক বান্ধবীর মাধ্যমে তার বাবা জানতে পারেন, আকাশ নামে এক ছেলের সঙ্গে এর আগে একাধিকবার তাকে দেখা গেছে।
এরপর আকাশের সন্ধানে নামেন ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা। আকাশের মোবাইলে ফোন করা হলে সে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তার ছলচাতুরীর বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ প্রযুক্তির সহায়তা নেয়। প্রযুক্তিগত ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর আগে কিশোরীর সঙ্গে আকাশের বহুবার যোগাযোগ হয়েছে। এদিকে আকাশ ও কিশোরীর মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারছিল না পুলিশ। ২৩ ডিসেম্বর ভিকটিমের মা বাদী হয়ে আকাশকে আসামি করে মামলা করেন। ২৪ ডিসেম্বর অভিযুক্তকে মাদারীপুর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তার একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে মুখ না খোলায় তাকে ২৮ ডিসেম্বর ফের আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তার দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। রিমান্ড শেষে আজ তাকে আবারও আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ জানিয়েছে, তার খালতো ভাই সুমনের মাধ্যমে কিশোরীকে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আকাশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গাইবান্ধায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় সুমনকেও। পরে তাদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আসাদুজ্জামান বলেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর থেকেই কিশোরীর মোবাইল ফোন বন্ধ রাখা হয়। তবে ফেসবুকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছিল। মোবাইল চালু থাকলে আসামি গ্রেফতার বা ভিকটিম উদ্ধার আমাদের জন্য সহজ হয়। শুরুতে আকাশের মোবাইল ফোন সচল থাকলেও আমাদের তৎপরতার বিষয়টি আঁচ করার পর তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ করে দেয়। এদিকে মেয়েটিকে বাসা থেকে বের করার পর আকাশ তাদের দুইজনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। ফেসবুক লিংক বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের তেমন কিছুই করার থাকে না। তাই ফেসবুকে তাদের সঙ্গে কী ধরনের কথোপকথন হয়েছিল, তা-ও বের করতে পারছি না। এসআই বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পক্ষ থেকেও ফেসবুক আইডি দুইটি উদ্ধারের অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি।
মামলার বাদী যুগান্তরকে জানান, পাচারের শিকার কিশোরী তার ছোট মেয়ে। তার কোনো ছেলেসন্তান নেই। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ছোট মেয়েকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। যে কোনো মূল্যে তিনি তার মেয়েকে ফেরত চান।