ভূপেন হাজারিকার গানের প্রথম অংশ মনে পড়ে যায়,”মানুষ মানুষের জন্য”। নাম পাখি দত্ত,ডাক নাম পাখি। ১৯৯২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারিতে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার মিকসিমিল গ্রামে জন্ম। বাবা মৃত মঙ্গল দত্ত ও মা রিনা রানী দত্তের তিন সন্তানের মধ্যে পাখি ২য়। পাখির জন্মের ২বছর পূর্বে তার বড় ভাই মারা যায়,ছোট বোন প্রাথমিকে পড়াশোনা করে।পাখির বয়স যখন ১২বছর শুরু হয় বয়সন্ধিকাল,তখন সে নিজেই থেকে বুঝতে পেরেছিলো আর অন্যসব সাধারণ ছেলে মেয়ের মত সে নয়। তার চলা ফেরায়,কথাবার্তায় নানা ভিন্নতা (তৃতীয় লিঙ্গের মত)। সামাজিক নানা বৈষম্যের মধ্যে সে বড় হতে লাগে। দিন যাচ্ছে বৈষম্যতা তার বেড়েই চলেছে। অদ্যম ইচ্ছা ছিলো পড়াশোনা করে বড় হয়ে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হব,কিন্তু বৈষম্যের কারণে তাকে সেই আশাটুকু বির্ষজন দিতে হলো! ছাড়তে হলো বিদ্যালয়ও। তার চারপাশের শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন,তুই এমন কেন? প্রতিনিয়ত অপমান সহ্য করতে হয় তার বাবা-মাকে। তার পরিচয় দিতে আতœীয় স্বজন লজ্জাবোধ করেন। কোথায় যাবে,কি করবো, বাবা-মায়ের কষ্ট আর সহ্য হচ্ছেনা তার। একদিন কাউকে না জানিয়ে, সবাইকে ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে,অবশেষে তার ঠাঁই হয় এক তৃতীয় লিঙ্গর (হিজড়া) বাড়ি।তৃতীয় লিঙ্গর মানুষদের সাথে থাকা সত্ত্বেও,তাদের পেশার সাথে সংযুক্ত থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে সাধারণ মানুষের মত অনুভূতি হতো।তার মনে হতো আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো সেও একজন মানুষ।তবে মানুষের কাছে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হবো কেনো?
সৃষ্টিকর্তা মানুষরূপে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। মানুষ যদি চেষ্টা করে তাহলে সব কিছু করা সম্ভব,তার চিন্তা ধারায় পরিবর্তন আসা শুরু করে। হিজড়া জনগোষ্ঠীসহ অসহায় মানুষদের নিয়ে কাজ করার অদ্যম ইচ্ছা তার মনে জন্ম নেয়। নিজের ইচ্ছা শক্তি ও চিন্তাধারাকে দৃঢ় করে তোলে। সে ভাবে আমার জন্ম পরিচয় কখনো আমার পরিচয় হবেনা, আমার কর্ম পরিচয়ই হবে আমার পরিচয়,এই প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয় তার পথ চলা। পাখির পরিচিত একজন শুভাকাংখির মাধ্যমে”বন্ধু”নামে একটি সংগঠনে তার সূচনা। সালটা তখন ২০১৭ বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির মাধ্যমে তার কর্মজীবনের পরিবর্তন। বের হয়ে আসে অনাকাঙ্খিত হিজড়া পেশা থেকে। বন্ধু সংগঠনে কর্মরত অবস্থায় তার বিভিন্ন সংগঠনের সাথে পরিচয় হয়। তখন সে দেখতে পায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর নাম ভাঙিয়ে এসব সংগঠনগুলো নিজেদের সাধ্য হাসিল করছেন। তখন পাখি ঠিক করে এই অসহায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কিছু করা উচিৎ। কিন্তু তার একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তখন সে তার সমমনা কিছু বন্ধুদেরকে এই ঘটনাটাগুলো খুলে বলে এবং সবাই তার সিদ্ধান্তে একাত্মা প্রকাশ করে,যে তাদের জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য তাদেরকেই কিছু করতে হবে,তবে শুধু তাদের জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করলে হবে না তাদেরকে কাজ করতে হবে সমাজের পিছিয়ে পড়া যুব নারী-পুরুষ, পথশিশু, হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী সহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে।কারণ হিজড়া জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।তখন পাখির নেতৃত্বে সবাই মিলে এসকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ২০২০ সালে”নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থা” নামে একটি সংগঠনের তৈরি করে। শুরু হয় নক্ষত্র মানব কল্যাণ সংস্থার কার্যক্রম। কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে তাদের সংগঠন থেকে ধাপে ধাপে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ত্রাণ সামগ্রী,কোভিডের সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ,প্রতিনিয়ত পথশিশুদের মাঝে রান্নাকরা খাবার বিতরণ, কোথাও কোন ক্ষয়-ক্ষতির কথা শুনলে সংগঠনের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের চেষ্টা,শীতকালে দুস্থ ও অসহায় মানুষদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ,রমজানে দুস্থ ও অসহায় মানুষদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণ,ঈদের সময় তার জনগোষ্ঠীর মাঝে সংগঠনের সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোষাক বিতরণ,দুস্থ শিশুদের মাঝে খাতা কলম বিতরণ এবং এলাকার মধ্যে কারও কোন সমস্যা হলেও নিজ উদ্যেগেও সাহায্য করার চেষ্টা।তার এই সমজ সেবাকে লক্ষকরে তার সংগঠনের সাথে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, নাগরিক উদ্যোগ,ওয়েভ ফাউন্ডেশন,ব্রাক,এমন নামি-দামি সংস্থাগুলো তার নক্ষত্র সংগঠনের সাথে কাজ করছে।পাখির “নক্ষত্র”সংগঠনটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর বয়স্ক ভাতা,হিজড়াদের মাঝে হিজড়া বিশেষ ভাতা, প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদান,হিজড়া জনগোষ্ঠীদের বিউটিফিকেশন,টেইলারিং এবং জীবন দক্ষতার উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।শুধু মাত্র তারা নিজেরা যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে আসতে পারে।পরিবারের হাল ধরা থেকও সে সব কিছুর মধ্য হতে চলমান রেখেছে তার পড়াশোনা।শুধু তাই নয়, তার কাজের বিনিময়ে সে ব্লাস্ট,বন্ধু,সাহিত্য সংস্থা, হিউম্যান লাইব্রেরী মত সংগঠের কাছ থেকে সন্মানিত হয়েছে।
পাখি জানান সমাজসেবামূলক কাজ করতে পেরে নিজেকে অনেক গর্বিত মনে করি। কারণ ছোটবেলা থেকে অনেক চড়াই-উতরাই করেও নানা রকম বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি,শিকার হতে হয়েছে ধিক্কার লাঞ্ছনা-বঞ্চনার। তখন সবাই আমাকে ঘৃণার চোখে দেখতো,আর আজ সবাই আমাকে পাখি আপা বলে ডাকে!কেউবা মা বলেও সম্মোধন করেন!আমি আমার কাজ দিয়ে পরিবর্তন করতে পেরেছি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির। আজ আর কেউ আমাকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না। সবাই আমাকে নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন এবং সবাই আমাকে অনেক ভালবাসেন। আমার অদম্য ইচ্ছা শক্তি আমাকে আমার সাফল্য এনে দিয়েছে। মানব জনম আমার সার্থক!
যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকবো এভাবেই মানুষের পাশে থেকে কাজ করে বাচতে চাই। আরোও ইচ্ছা আমার মাধ্যমে, আামার জনগোষ্ঠীর মানুষেরা হিজড়া পেষা থেকে বের হয়ে যেনো নতুন কর্মসংস্থান খুজে পায়।আমাদের দরকার এমন পাখির যার মাধ্যমে দেশের ও একটি জনগোষ্ঠীর পরিবর্তন হতে পারে।পাশাপাশি দরকার সকলের সহযোগিতা সহ সরকারি সহযোগিতা।উৎসাহ, অনুপ্রেরণা মানুষেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়।ভালো কিছুর মাধ্যমে পরিবর্তন সকলেরই কাম্য!