সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৮৮ লাখ ৫০ হাজার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ঈদের আগেই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (নগদ ও বিকাশ) মাধ্যমে ভাতা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। চারটি বৃহৎ কর্মসূচির (বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি) আওতায় এই ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতর। কর্মকর্তারা বলছেন, মুজিববর্ষে প্রায় ৯০ লাখ অসহায় দরিদ্র মানুষকে মোবাইলের মাধ্যমে ভাতা দেওয়া সরকারের একটি বড় সাফল্য।
বর্তমানে সমাজসেবা অধিদফতর ৫০টির বেশি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার চারটি বৃহৎ কর্মসূচির আওতায় ৮৮ লাখ ৫০ হাজার দরিদ্র মানুষ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ভাতা পেয়ে আসছে। যা এতদিন ভাতাভোগীরা ব্যাংকের মাধ্যমে পেয়ে আসছিল। ভাতাভোগীদের মধ্যে রয়েছেন- ৪৯ লাখ বয়স্ক, ২০ লাখ ৫০ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী এবং ১৮ লাখ প্রতিবন্ধী। এ ছাড়া ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমান সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ১১টি উপজেলায় জিটুপি (সরকার থেকে ব্যক্তি) পদ্ধতিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতা প্রদান কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে দেশের সব উপজেলায় জিটুপি পদ্ধতিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস কর্মসূচির পরিধি বিস্তৃত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সভায় সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তার চারটি বৃহৎ কর্মসূচি মুজিববর্ষে জিটুপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। তখন থেকে ভাতার টাকা মোবাইল ফোনে পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
এ জন্য সরাসরি জিটুপি পদ্ধতিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে সীমিত জনবল নিয়ে করোনা মহামারির মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিরলসভাবে কাজ করেছে বিভিন্ন স্থরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নগদ ও বিকাশের সঙ্গে চুক্তি করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তারপর থেকে শুরু হয় ভাতাভোগীদের এমআইএস ও মোবাইলে হিসাব খোলার কাজ। এরপর গত ১৪ জানুয়ারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দেশের ১১২টি উপজেলায় মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের (নগদ ও বিকাশ) মাধ্যমে ভাতা প্রদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে চারটি কর্মসূচির (বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি) আওতায় প্রায় ১২ লাখ ভাতাভোগীকে ভাতা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়।
ভাতার প্রদান কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. শফিউল ইসলাম জুয়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঈদের আগে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ভাতাভোগী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে মোবাইলে ভাতা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জিটুপি পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে এখন থেকে উপকারভোগীরা নির্বিঘ্নে ঘরে বসেই ভাতার টাকা নিজেদের নগদ/বিকাশ হিসাব থেকে তুলতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার চারটি বৃহৎ কর্মসূচি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নে আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনাকালেও দিন-রাত কাজ করেছি। এ সময়ে উপকারভোগীদের হিসাব খোলা, এমআইএসে ডাটা অ্যান্ট্রিসহ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করেছি। ফলে এখন থেকে ভাতা পেতে উপকারভোগীদের আর কোনো ভোগান্তি পোহাতে হবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতরের ময়মনসিংহ জেলার উপপরিচালক আবু আব্দুল্লাহ মো. ওয়ালী উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই আমরা ময়মনসিংহ জেলার ১৩টি উপজেলা ও একটি সিটি করপোরেশন মিলিয়ে মোট ২ লাখ ৭৫ হাজার ৪৩০ জন ভাতাভোগীর কাছে মোবাইল সার্ভিসের (নগদ/বিকাশ) মাধ্যমে ভাতা পৌঁছে দিতে পেরেছি। ফলে ভাতাভোগীদের টাকা উঠানোর কষ্ট স্থায়ীভাবে কমে গেল।’
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত নয়, সেসব জেলাতেও নগদ/বিকাশের মাধ্যমে উপকারভোগীরা ভাতার টাকা পেয়েছেন। এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার উপপরিচালক সুচিত্রা রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুনামগঞ্জ জেলার চারটি উপজেলার মধ্যে তিনটি হাওর এলাকা ও একটি পৌরসভার প্রায় ৪৯ হাজার ভাতাভোগীকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে ভাতা পৌঁছে দিয়েছি। এখন থেকে এই জেলার সকল উপকারভোগী খুব সহজেই তাদের ভাতার টাকা নিজ নিজ হিসাব থেকে তুলতে পারবেন।’
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে বয়স্ক ভাতা ও ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা প্রদান কর্মসূচি চালু হয়। বর্তমানে শতভাগ প্রতিবন্ধীকে ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ১১২টি উপজেলার ভাতা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ বয়স্ক ব্যক্তি এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাকে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। সরকার পর্যায়ক্রমে দেশের সকল বয়স্ক ব্যক্তি এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাকে ভাতার আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও দেড় শতাধিক উপজেলাকে শতভাগ ভাতার আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
এছাড়া গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে (ইএফটি) প্রদানের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন প্রদানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে প্রায় ২ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে প্রতি মাসে সম্মানী ভাতা হিসেবে ১২ হাজা টাকা করে দিচ্ছে সরকার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা প্রদানের কার্যক্রমও সমাজসেবা অধিদফতর বাস্তবায়ন করে থাকে।
সার্বিক বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) সাব্বির ইমাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির চারটি বৃহৎ ভাতার টাকা ঈদের আগেই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছি। এই টাকা সারাদেশের ৮৮ লাখ ৫০ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ হিসাব নম্বরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে প্রায় ৭৬ লাখ এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১২ লাখ ৮৬ হাজার জনগোষ্ঠীকে ভাতা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি মুজিববর্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি নিজ নিজ হিসাবে ভাতা পৌঁছে দেওয়াটা সরকারের একটি বড় সাফল্য। আমরা পর্যায়ক্রমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সব ভাতা প্রদান কর্মসূচি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আওতায় নিয়ে আসব।’