চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃদুয়ারে কড়া নাড়ছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠ। পাইকার আর ব্যবসায়ীদের দেন-দরবারে স্বভাবতই এখন কর্মমুখর থাকার কথা ‘লিচুর রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত ঈশ্বরদীর লিচু মোকামগুলো। অথচ এসব লিচুই এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সহস্রাধিক চাষি ও ব্যবসায়ীদের।
৩-৪ দিন পরই লিচু উঠবে বাজারে। অথচ করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আগাম টাকা দিয়ে আড়ত থেকে লিচু বায়না করতে এখনো আসা শুরু করেনি পাইকাররা। উল্টো বায়না করা বাগান ফেরত দিয়ে টাকা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ক্ষুদ্র, বাণিজ্যিক ভিত্তিক লিচু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা কার কাছে লিচু বিক্রি করবেন, সে হিসেব মেলাতে পারছেন না।
লিচু বাগান মালিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ফলন ভালো হলেও এবার ক্রেতা নেই। লিচুর ফুল আসা শুরুর পর অনেক বাগান কেনাবেচা হয়েছে। তবে করোনার কারণে লকডাউন শুরুর পর লিচু বিক্রির অনিশ্চয়তা থেকে বাগান দিয়ে আগাম টাকা ফেরত নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। বাগান ফেরত পেয়ে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। বাগান আগাম নেওয়া ব্যবসায়ীরাই লিচুর বাজারজাতকরণ সম্পর্কে প্রকৃত ওয়াকিবহাল। তাই বিপুল পরিমাণ লিচু বিক্রি নিয়ে মালিকদের বেগ পেতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক চাষি এবার লিচুর কাঙ্ক্ষিত দাম ও বিক্রি নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
উপজেলার চাঁদপুর চরের লিচু চাষি আলম হোসেম জানান, ‘প্রায় ১০ বিঘার ৮টা বাগান ইজারা নিয়েছেন তিনি। যেখানে ১০০ টির মতো লিচু গাছ রয়েছে। বাগান প্রতি ইজারা ব্যয় ও কীটনাশকসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও ফলন ভালো। এরইমধ্যে কিছু গাছে লিচু পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এবার ঢাকার পাইকাররা আসবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
সলিমপুরের লিচু ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের লিচুর বাজার বাইরের ক্রেতা নির্ভর। করোনার কারণে অন্য জেলা থেকে মহাজন, ব্যাপারী ও ফড়িয়ারা এবার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। তাই আমরাও বাগান নেওয়া বা চাষিদের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে আসতে পারছি না। এবার প্রায় বাগানেই ফলন ভালো হওয়ায় ন্যায্যমূল্য নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।’
লিচু চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউনের আগে অগ্রিম প্রদান করে বাইরের এক পাইকার তাদের একটি বড় বাগান নেন। তবে লকডাউনের কারণে অগ্রিম অর্থ ফেরত নিয়ে গেছেন। এখন বাগানভর্তি লিচু নিয়ে বিপদে পড়েছি। যারা নিয়মিত ব্যবসায়ী তারা জানেন লিচুর বাজার সম্পর্কে, যা আমার জানার কথা নয়। এখন লিচু কীভাবে বিক্রি করবে সেটাই ভাবছি।’
কামালপুর চর এলাকার চাষি সাকিব আল হাসান সোহেল জানান, তাদের তিন বিঘার বাগানে এবার ভালোই লিচু ধরেছে। এখন পর্যন্ত অর্ধ লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছেন কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ। ঝড়-বাদলে না ঝরলে লিচু শেষ পর্যন্ত ভালো লিচু আহরণ করা যাবে। কিন্ত লকডাউন পরিস্থিতিতে কোন পাইকার লিচু কিনতে না এলে লোকসানে স্থানীয় বাজারে লিচু বিক্রি করতে হবে।
মানিকনগরের লিচু চাষি বাদশাহ প্রামাণিক বললেন, ‘লিচু বাজারজাতকরণ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এমনিতেও পচনশীল হওয়ায় লিচুতে সবসময় ঝুঁকি থাকে, এবার তা অন্যবারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। লিচু আহরণ ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ১০ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন। লিচুর কোটি টাকার ব্যবসা এবার অনিশ্চিত।
উপজেলা কৃষি বিভাগের জরিপ অনুসারে, এখানে তিন হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। গাছের সংখ্যা তিন লাখের ওপর। এর মধ্যে দুই লাখ গাছের বয়স ১৫ বছরের বেশি। এ ছাড়া সারা উপজেলাতেই বসতবাড়ির আশপাশেও রয়েছে প্রচুর লিচুগাছ। লিচু চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ। তাঁদের হিসাবে বড় গাছগুলোতে এবার নিম্নে ১০ হাজার, ঊর্ধ্বে ২৫ হাজার পর্যন্ত লিচু ধরেছে। অপেক্ষাকৃত ছোট গাছে লিচু এসেছে তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। বড় গাছে গড়ে ১০ হাজার ও ছোট গাছে ৩ হাজার করে ধরলে এবার লিচুর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। পাইকারিতে গড়ে প্রতি লিচুর দাম দেড় টাকা ধরা হলেও দাম হয় ৩৪৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে বসতবাড়ির আশপাশের গাছের লিচুর দাম।