বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নির্লোভ, দেশপ্রেমিক, নিবেদিতপ্রাণ এক অকুতোভয় সংগঠকের নাম শামছুর রহমান মানি; আদর্শের পথে অটুট থেকে শত প্রাপ্তির প্রলোভনকে তুচ্ছজ্ঞান করে যিনি শত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার বন্ধুর পথ বেছে নিয়েছেন হাসিমুখে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঝান্ডা ধরেছেন শক্ত হাতে। শামছুর রহমান মানির জন্ম ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বড়ফা গ্রামের অভিজাত মোল্লা পরিবারে। পিতা একাত্তরের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ আলী মোল্লা। দাদা গগন মোল্লা ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তিন ভাই শামছুর রহমান মানি, শামছুল আবেদীন এবং শামছুল আলমের মধ্যে মানি ছিলেন বড়। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে। বাসা ভাড়া করে থাকতেন স্কুলের পার্শ্ববর্তী এলাকায়। বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের মন্ত্রী ও সহপাঠী মোল্লা জালাল উদ্দীন আহমদ ছিলেন তার মামা।
১৯৪৫ সালে মামা মোল্লা জালাল উদ্দীন এর সূত্র ধরে সেদিনের সাহসী মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবের সাথে পরিচয় হয় ১২-১৩ বছরের সুদর্শন কিশোর হাইস্কুল ছাত্র শামছুর রহমান মানির। তার ভাষায় হ্যাংলা, লম্বা গড়নের, মায়াবী কালো চেহারার, ভরাট কণ্ঠের অধিকারী মুজিবের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য আকর্ষণ ক্ষমতা ছিল। প্রথমবার দেখা আর সামান্য কথোপকথনেই তার প্রতি আকৃষ্ট হন মানি। ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তির উদ্দেশ্যে ঢাকায় যান তিনি। ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে মামার কাছে। মামা মোল্লা জালাল উদ্দীন আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান তখন একই হলে থাকতেন। শান্তশিষ্ট এবং লাজুক প্রকৃতির মানিকে দেখে শেখ মুজিবুর রহমান মোল্লা জালালকে পরামর্শ দেন তাকে ঢাকার পরিবর্তে খুলনায় ভর্তি করার।
ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তখন সদ্য পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে দিয়ে খুলনায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করবেন এমন একটি চিন্তা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। কলেজে ভর্তির তারিখ ইতিমধ্যে পার হয়ে যাওয়ায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ অধ্যক্ষ চারু মজুমদারকে চিঠি লিখে দিলেন মানির হাতে। শামছুর রহমান মানি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন বিএল কলেজে। থাকতেন খুলনার বয়রা ইউনিয়নের রায়েরমহল গ্রামে চাচার শ্বশুরবাড়িতে। রায়েরমহল এলাকায় বসবাস করা এবং ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারনে এই এলাকার আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, মঞ্জুরুল ঈমাম, মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ দবিরুল ইসলাম, শেখ আব্দুল করিম, শেখ আব্দুল গফফার, শেখ হিসাম উদ্দীন আহমদ এবং এফ এম মাকছুদুর রহমান সহ নেতৃবৃন্দের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ৬০’ র দশকে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নির্বাচিত ভিপি ছাত্রলীগের জনপ্রিয় নেতা শেখ শহীদুল হকের সাথে তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।
কলেজে পড়ালেখার সূত্রে সম্পর্ক তৈরি হয় হাজী বাড়ির মোহাম্মদ আলীর সাথে। সখ্যতা তৈরি হয় রায়েরমহলের আব্দুল হামিদ এর সাথে, দৌলতপুর এলাকার বন্দ এবং মোড়ল পরিবারের সাথে। ৫০’র দশকের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমান বিএল কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি করেন। খুলনাতে সম্ভবত এটাই ছিল ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি। কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন শামছুর রহমান মানি।
গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর কিছুদিন শিক্ষকতা করেন ডুমুরিয়া হাইস্কুলে। খুলনা-৫ আসনের বর্তমান সাংসদ, সাবেক মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ ছিলেন তার ছাত্র।
৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ সদর ও কোটালিপাড়া আসন থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রার্থী হলে সদ্য বিবাহিত যুবক মানি সেখানে যান নির্বাচনী ওয়ার্কে। শেখ মুজিব বড়ফা সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নির্বাচনী গণসংযোগ শেষে একদিন রাতে আহমেদ আলী মোল্লার বাড়ীতে যান। অনেক নেতাকর্মীসহ সেখানেই রাত্রিযাপন করেন তিনি। আশপাশের আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সেদিন শেখ মুজিবকে এক নজর দেখতে এবং তার কথা শুনতে ভীড় করেন শামসুর রহমান মানিদের বাড়িতে। এ থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মোল্লা পরিবারের ঘনিষ্ঠতা পঞ্চাশের দশক কিংবা তার আরও আগে থেকে। শামছুর রহমান মানিকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার কাছ থেকে তিনি খুলনার ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতেন।
বঙ্গবন্ধু খুলনায় আসলে তার সাথে সার্বক্ষণিক ছায়ার মত থাকতেন মানি। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করার কিছুদিন পূর্বে ১৯৬৬ সালে খুলনায় ছোট ভাই শেখ আবু নাসের এর নূরনগরের বাসায় আসলে খুলনার গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাথে সেখানে গিয়ে সাক্ষাত করেন। শামছুর রহমান মানি এ সময় উপস্থিত ছিলেন। খুলনার ডালমিল এলাকায় বসবাসকারী বঙ্গবন্ধুর শ্যালক শেখ মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে, খালিশপুরের আওয়ামীলীগ নেতা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান রহমান চৌধুরীর বাড়িতে এবং জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা এম এ বারীর টিবি ক্রস রোডস্থ বাসায় ছয় দফা প্রচারকালীন এবং ৭০’র নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু আসলে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দের সাথে তার সফরসঙ্গী হয়েছেন এবং তার সাথে ভোজে অংশ নিয়েছেন শামছুর রহমান মানি। খুলনায় আওয়ামীলীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে তার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৬-৬৭ সালে ইকবাল নগর স্কুলের পাশে বাড়ি নির্মাণ করেন শামছুর রহমান মানি। ‘৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার উক্ত বাড়ি অধিগ্রহণ করলে আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাল সময়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাকে বাসা ভাড়া করতে হয় শহরের মৌলভী পাড়ায়। সেখান থেকে স্ত্রী এবং ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর স্বর্ণালংকার বিক্রি করা টাকা দিয়ে শহরের সাত রাস্তার মোড়ে কেনা জমিতে নির্মিত বর্তমানের এই বাড়িতে ওঠেন ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এই সহচর ১৯৬৯ সালে নির্বাচিত হন খুলনা আওয়ামীলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির পর শামছুর রহমান মানি একদিন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িতে যান সাংগঠনিক বিষয়ে পরামর্শ নিতে। আসার সময় বঙ্গবন্ধুর কথামত শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জোর করে তার হাতের মধ্যে ৫০০ টাকা গুঁজে দেন।
৭০’র নির্বাচনে খুলনা সদর আসনের জাতীয় পরিষদ প্রার্থী আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ মহসীন এবং প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী হাবিবুর রহমান খান সহ অন্যান্য প্রার্থীদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আওয়ামীলীগের এই নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। এই নির্বাচনে ভরাডুবি হয় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা খান এ সবুর, আবুল হোসেন হাসান সাহেব সহ পাকিস্তানপন্থী গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের। জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া আওয়ামীলীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে ক্ষমতা হস্তান্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া টালবাহানা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বপরিবারে গোপালগঞ্জের বড়ফা গ্রামে চলে যান শামছুর রহমান মানি।
গ্রামে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার ১৪-১৫ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ পুত্র মিজানুর রহমান মিজান আত্মগোপনে থেকে রাজাকার ও পাকিস্তান আর্মির গতিবিধির দিকে নজর রাখতেন। তাদের অবস্থান এবং কর্মকান্ড সম্পর্কে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে জানিয়ে দিতেন। তবে পাকিস্তান আর্মির ঘনঘন টহলের কারনে কিছুদিনের মধ্যেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন শামছুর রহমান মানি সহ পরিবারের সদস্যরা। আশ্রয় নেন নড়াইল জেলার ইটনা গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে। কিছুদিনের মধ্যে ইটনা গ্রাম ও পাকহানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফলে সেখান থেকে আবার ফিরে আসেন নিজ গ্রাম বড়ফায়। গ্রামে ফিরেই মুখোমুখি হন জীবনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনার।
১৯৭১ সালের ১৭ ই মে সকাল আনুমানিক ১০ টার দিকে গ্রামে প্রবেশ করে পাকহানাদার বাহিনীর মানুষরুপী হায়েনার দল। সেদিন বাড়িতে ছিলেন না শামছুর রহমান মানি। পাক আর্মির গ্রামে প্রবেশের খবর পেয়ে বাড়ির সবাই খালের কচুরিপানার আড়ালে আশ্রয় নেন। গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার কালু শেখ হানাদার বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগ নেতা মানির বাড়ি দেখিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর উগ্র সদস্যরা বাড়িতে ঢুকে তাকে না পেয়ে তার সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ পিতা আহমেদ আলী মোল্লাকে তাদের পারিবারিক মসজিদ থেকে কুরআন শরীফ তেলাওয়াতরত অবস্থায় টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে বাড়ীর উঠানে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। কাপড়চোপড়, ধানের গোলা এবং আলু, পেয়াজের গুদাম ঘরে লাগানো হয় আগুন। বাড়ির কাচারিঘর এবং তৎসংলগ্ন লাইব্রেরীতেও আগুন দেয় হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর সদস্যরা। চারিদিকের আগুনের লেলিহান শিখায় উঠানে পড়ে থাকা আহমেদ আলী মোল্লার নিথর দেহটি ও পুঁড়ে দগ্ধ হয়।
পিতার বুলেটবিদ্ধ দগ্ধ দেহটি একনজর দেখার এবং দাফনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন পুত্র শামছুর রহমান মানি। পিতার জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়। বিজয়ের পর চলে আসেন খুলনার মৌলভীপাড়ার ভাড়া বাসায়। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পর আহমেদ আলী মোল্লার শহীদ হওয়ার নৃশংস ঘটনা এবং অগ্নিকান্ডে ঘরবাড়ীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানতে পারেন। শহীদ পরিবার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাদেরকে ২০০০ টাকা অনুদান দেন। বঙ্গবন্ধু পিতৃহারা শামছুর রহমান মানিকে ডেকে তাকে গভীর সমবেদনা জানান। সরকারের পক্ষ থেকে তার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দের প্রস্তাব দেন বঙ্গবন্ধু। শামছুর রহমান মানি বিনয়ের সাথে এই প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পূনর্গঠনের কর্মযজ্ঞ শুরু হলে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে আওয়ামীলীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে প্রতিটি কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৩ সালের খুলনা পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মানি। আওয়ামীলীগের একাধিক প্রার্থী থাকায় অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় শামছুর রহমান মানি তার অসুস্থ ছোট ভাই শামছুল আলমের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে হাসপাতালে ভর্তি ও কেবিনের ব্যবস্থা করেন। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এবং মেজ ভাই ১৯৬১ সালে সদ্য এমবিবিএস পাশ করার পরপরই মারা যান। এ জন্য তাকেই পরিবারের সব দায়িত্ব পালন করতে হত। ১৪ আগস্ট রাতে খুলনার তৎকালীন এমপি এ্যাডভোকেট মমিনউদ্দীন আহমদ, আওয়ামীলীগ নেতা মোল্লা এমদাদুল হক এবং তিনি গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসভবনে এ্যাডভোকেট মমিনউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রী করার প্রস্তাব নিয়ে।
পরদিন ১৫ ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামের কারনে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু তাদেরকে দু’একদিন পরে দেখা করতে বলেছিলেন। রাত প্রায় ১১ টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে বেরিয়ে শামছুর রহমান মানি যান হাসপাতালে ভর্তি ছোট ভাইয়ের কাছে। ঐ রাতেই ঘটে যায় পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকান্ডের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে। রাতে যার সাথে সাক্ষাত করলেন সকালে তার স্বপরিবারে হত্যার সংবাদ তার কাছে ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন অনেকেই রাতের অন্ধকারে হাত মিলিয়েছেন খুনীদের দোসর মোস্তাক, জিয়ার সরকারের সাথে। তখন শামছুর রহমান মানি বেছে নিয়েছেন যাযাবর জীবন আর শত নির্ঘুম রাত। আদর্শের সাথে আপোষ করেন নি, বিনিময়ে হয়েছেন মামলার আসামি।
সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া চিঠি লিখেছিলেন বিএনপিতে যোগদানের প্রস্তাব দিয়ে। আহবান জানিয়েছিলেন সরকারকে সমর্থনের। সেই চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছেন ময়লার ঝুঁড়িতে, বিনিময়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারে। অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি থেকেছেন অটল। দীর্ঘদিন মহানগর আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। আওয়ামীলীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর যেমন আস্থাভাজন ছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু কন্যার ও ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। শিক্ষানুরাগী শামছুর রহমান মানি নগরীর ঐতিহ্যবাহী ইকবাল নগর স্কুল এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই রাজনীতিক এবং সমাজসেবক ২০০৭ সালের ১১ ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
শামছুর রহমান মানির জ্যেষ্ঠ পুত্র মিজানুর রহমান মিজান পিতার নির্দেশে ১৯৮৪ সালে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে যুক্ত হন খুলনা মহানগর যুবলীগের রাজনীতিতে। ১৯৮৫ সালে মহানগর যুবলীগের আহবায়ক হয়ে মৃতপ্রায় যুবলীগকে খুলনার মাটিতে সংগঠিত করেন, শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করেন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে রাখেন সাহসি ভূমিকা। ১৯৮৮ সালে পিতা-পুত্র দুই দিনের ব্যবধানে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ৯ মাস জেল খাটেন। ১৯৯২ সালে মহানগর যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন কর্মিদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় মিজান। যুবলীগের একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে কর্মি অন্তপ্রাণ সদা হাস্যজ্বল মিজান খুলনার হাজারো ছাত্র, যুবকের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নেন খুব দ্রুতই।
মিজানুর রহমান মিজানের রাজনৈতিক ক্যারিশমায় ছাত্র ও যুবসমাজ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পতাকাতলে আসতে থাকে। খুলনা মহানগর যুবলীগ একটি শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি পায় তার সুযোগ্য বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। ২০০২ সালে নগর আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি। সাংগঠনিক দক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে দুই বছরের ব্যবধানে ২০০৪ সালের ১৫ ই জানুয়ারি মাত্র ৪৭ বছর বয়সে খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের মত ঐতিহ্যবাহী ইউনিটের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে তিনিও আহত হন। ২০০৭-০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় শেখ হাসিনার মুক্তি এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন।
শামছুর রহমান মানির আরেক পুত্র মাসুদুর রহমান ৮০’র দশকের মধ্যভাগে খুলনা সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সিটি কলেজে ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করেন। পরবর্তীতে জাপানে প্রবাস জীবন বেছে নেওয়া মাসুদ জাপান আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তার কন্যা এ্যাডভোকেট সুলতানা রহমান শিল্পী খুলনা মহানগর মহিলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামীলীগের চরম দুঃসময়ে খুলনা মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের জনপ্রিয় নেত্রী ছিলেন তিনি।
ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান মিজানুর রহমান মিজানের চলাফেরা অতি সাধারন। সদা হাস্যজ্বল কর্মি অন্তপ্রাণ এ নেতা সহজেই মানুষকে বুকে টেনে নিতে পারেন, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে পারেন। এ কারনে সাধারন মানুষ এবং দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খুলনা-২ আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেয়ে মাত্র ১৬৯০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন মিজান। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে পুনরায় দলের মনোনয়ন পেয়ে ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মত বিপুল ভোটে নৌকার বিজয় এনে দেন। এমপি নির্বাচিত হয়ে খুলনা মহানগরের অন্তর্গত সদর ও সোনাডাঙ্গা থানাধীন এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা ও জনগনের সাথে নিবিড় সম্পৃক্তির মাধ্যমে জনগনের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন।
শিক্ষাখাতে তার নেতৃত্বে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়। একাধিক স্কুল, কলেজ সরকারীকরণ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়।আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন খুলনার দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশনটি তার মেয়াদে নির্মিত। বিভিন্ন মসজিদ, মন্দিরে তার উদ্যোগে উন্নয়নবান্ধব শেখ হাসিনার সরকারের আমলে প্রচুর পরিমাণে অনুদান দেওয়া হয়।খুলনার ইতিহাসের সবচেয়ে সফল
ও কর্মঠ মেয়র জননন্দিত জননেতা তালুকদার আব্দুল খালেক এবং সাংসদ মিজানুর রহমান মিজানের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড ও জনসম্পৃক্তি খুলনাকে পরিণত করে নৌকার ঘাঁটিতে। ফলে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিপুল ভোটে পরাজিত হন নৌকার প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ আবু নাসের এর সুযোগ্য সন্তান জননেতা শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলের কাছে। মনোনয়ন বঞ্চিত আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান দল মনোনীত প্রার্থীর বিজয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শহীদ পরিবারের সদস্য, শামছুর রহমান মানির আদর্শিক রক্তের উত্তরসুরি, সাবেক সাংসদ আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজানের মতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের এবং বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হয়েছে। খুনীদের ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়েছে। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের। পিতা আলহাজ্ব শামছুর রহমান মানির স্বপ্ন ছিল বাংলার মাটিতে একদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তবু ও তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এটা তার সন্তান হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয়। তবে ব্যথিত হয় যখন দেখি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দূর্দিনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মিরা অবমূল্যায়িত হয় হঠাৎ অবৈধভাবে কালো টাকার মালিক হয়ে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশকারী আদর্শহীন নব্যদের ভীড়ে।
রাজনীতিতে আদর্শহীন, সুবিধাভোগী নব্যদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হোক- সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নেতাকর্মীরা মূল্যায়িত হোক। বঙ্গবন্ধুর আজীবন সহচর শামছুর রহমান মানির মৃত্যুবার্ষিকীতে এটাই হোক আমাদের স্লোগান। তাহলেই আওয়ামীলীগ হবে কলুষমুক্ত এবং শক্তিশালী। আওয়ামীলীগের জন্য এটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট ও তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা