বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ পাকিস্তান। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২০ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৫তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
২০২০ সালের ইনডেক্সে তিন দাপ নিচে নেমে গেছে পাকিস্তানের অবস্থান। দেশটির সেনাবাহিনীর সমালোচনা করায় পাকিস্তান ইলেকট্রনিক ক্রাইমস অ্যাক্ট ২০১৬ (পিইসিএ) এর আওতায় অনেক লেখককে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
পিইসিএ আইনকে মানুষের ঠোঁট চেপে ধরার চূড়ান্ত হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি এ আইনে নতুন একটি ধারা সংযুক্ত করা হয়। সেই ধরায় বলা হয়েছে, যারা পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে উপহাস করে, তাদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে কিংবা তাদের সুনাম নষ্ট করে, তাদের দুই বছরেরও বেশি সময় কারাদণ্ড দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তাদের জরিমানাও করা হবে।
পিইসিএ আইনে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক আসাদ আলী তুর। তিনি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়ার সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয়টি হলো তাকে কখনোই বলা হয়নি যে, তার কোন ট্যুইটকে অবৈধ বলে গণ্য করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কে বা কারা এফআইআর দায়ের করেছিলেন সেটিও জানানো হয়নি।
তিনি বলেন, লাহোরের হাইকোর্টে শুনানির সময়ও আমাকে বলা হয়নি। যখন আপনি কোনো অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন, কিন্তু আপনি জানেন না, কি করেছেন- এটা খুব হতাশার বিষয়।
গত বছর পাকিস্তানি রাষ্ট্র এবং এর সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’ চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল সাংবাদিক তুরের বিপক্ষে। সামা টিভিতে তিনি কাজ করতেন। তার চাকরি যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই এই অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাকিস্তানি রাষ্ট্র ও এর সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক’ প্রচারণা চালাচ্ছেন।
তার মামলাটি নিয়ে লড়েছিল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মিডিয়া ম্যাটার্স ফর ডেমোক্রেসি এবং পাকিস্তানি বার কাউন্সিলের ‘সাংবাদিক প্রতিরক্ষা কমিটি’। এই সংস্থাগুলো সাংবাদিকদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা এবং সেবা প্রদান করে। প্রমাণের অভাবে নভেম্বর মাসে তাকে লাহোর হাইকোর্ট সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।
তুর ছাড়াও আরও দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বরের একই সপ্তাহে ‘বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার’ অভিযোগ আনা হয়েছিল। দেশের বিরুদ্ধে ‘বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া’র অভিযোগ আনা হয়। সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ নিউজ এডিটর ফারুকী। তার পরিবারের দেওয়া তথ্যমতে, সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্ট দেওয়ার পরে করাচির বাসা থেকে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয় পিইসিএ আইনে।
মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়ায় আনা জবাবদিহি ও সমালোচনা এড়াতে চায় পাকিস্তান রাষ্ট্র। এ জন্যই পাকিস্তানে এত সংখ্যক সাংবাদিককে টার্গেট করা হয়। এমনটাই মনে করেন তুরের মামলা নিয়ে কাজ করা সংস্থার সদস্য ইমান জয়নব মাজারি-হাজির। তিনি বলেন, এ বিষয়টি বাকস্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার ওপর প্রভাব ফেলবে। সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত এমন অনেক বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না।
পাকিস্তানি ডিজিটাল সংস্থা ‘বলো ভাই’র উদ্ধৃতি দিয়ে ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কন্টেন্ট ব্লক করা এবং সরিয়ে দেওয়ার ৮৪টি ঘটনা ঘটেছে। ২০০৬ সাল থেকে সরকার ডিজিটাল সাংবাদিকদেরও টার্গেট করা শুরু করেছে। শুধু ২০০৬ সাল থেকে একহাজার ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণা করা হচ্ছে, ডেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সরকার ইন্টারনেট ফিল্টারিং সরঞ্জাম এবং ব্লকিং সিস্টেমের জন্য এক কোটি মার্কিন ডলারের বাজেট বরাদ্দ করেছে। ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটির সরকার ৩৬টি ঘোষণা দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে।