চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃদুর্নীতির বিষয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রী-এমপি, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতার তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট ১৫০ জনেরও অধিক ব্যক্তির তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্র মতে, সরকারের ৫ মন্ত্রী, ৩৫ এমপি, সাবেক ১০ মন্ত্রী ও ৫০ এমপি, ৪ সিটি মেয়র, ৬ পৌর মেয়র, ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের শতাধিক, সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে প্রশাসনের শতাধিক বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, অধিপ্তরের ৩০ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৩০-৪০ সদস্যের দুর্নীতির অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা বলেন, ‘গত জুন মাসের আগেই বর্তমান মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন কারণে অভিযুক্ত নেতাদের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কয়েকটি মাঠ জরিপের পর গত এপ্রিলে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে ৫০ মন্ত্রী-এমপির বিষয়ে খোঁজ নিতে দুদককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুবলীগের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আসে। সেই সময় তিনি ইসমাইল হোসেন সম্রাটসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে দলীয় ফোরামে কয়েক নেতাকে খোঁজখবর নেয়ার নির্দেশ দেন।তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন সংস্থা এবং শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে বিশেষ টিম সারা দেশে জরিপ করে। সেই জরিপের পর নির্বাচনের দুই মাস আগেই আওয়ামী লীগ সভাপতি গণভবনে নেতাকর্মীদের প্রায় সব বৈঠকেই বলেছেন, এরপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান হবে। দল থেকে শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের তালিকা অনেক বড়। সেখান থেকে ৩৫০ জনের সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজের তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিশেষ টিম।’ দলের গুটিকয় নেতা ছাড়া এই তালিকা সম্পর্কে কেউই জানে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এনবিআরের গোয়েন্দা ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কাছে একটি তালিকা রয়েছে। সেখানে শুধু রাজনীতিকরাই নন, প্রশাসন, পুলিশ ও অন্যদের তালিকাও রয়েছে। দুদকের একজন পরিচালক বলেন, ‘গত ১৫ দিনে তাদের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সরকারের কয়েক মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, পুলিশসহ অনেকের সম্পদের অনুসন্ধানের নির্দেশনা এসেছে। কাজ চলছে। এরই মধ্যে অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাসিনোর শত শত কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারার সঙ্গে রাজনীতিবিদ ছাড়াও প্রশাসনের কোন স্তরের কারা জড়িত, তাদের বিষয়ে নানা মাধ্যমে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে দুদকের কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অনুসন্ধান করতে পারবে।
জানা গেছে, সরকারদলীয় অনেকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অবৈধ সম্পদসহ নানা অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত যারা মন্ত্রী, এমপি এবং বড় বড় পদে ছিলেন তাদের সম্পদের খোঁজ নেয়া হচ্ছে। দুদকের নথিতে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম রয়েছে- নরসিংদীর সাবেক ও বর্তমান দুই এমপি, খুলনার সাবেক এক এমপি, পিরোজপুর ও বরগুনার সাবেক দুই এমপি, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সাবেক এমপি, মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা, যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ও সাবেক একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলে।
আরো জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতিসহ বর্তমান ও সাবেক অন্তত ‘হাফ ডজন’ এমপির বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান নথিভুক্ত হলেও পুনরায় সচল করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন চাওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগের বিদায়ী দুই নেতা ও ক্যাসিনোর ঘটনায় রাজধানীর ১০ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামও রয়েছে দুদকের অনুসন্ধান তালিকায়।
অবৈধ’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রথম পর্যায়ে সাতজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে কমিশন। তারা হলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সাংসদ আসলামুল হক, সাংসদ এনামুল হক, সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি ও সাবেক সাংসদ এম এ জব্বার। তাদের তলব করা শুরু করেছে দুদক।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সদস্য বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই সরকারপ্রধান দুর্নীতিতে তার জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী পরিষদের প্রথম বৈঠকেই দলীয়প্রধান হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, দল থেকে প্রথম দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘দুর্নীতিবাজরা কেউই রেহাই পাবে না। দলের হোক বা যেখানকারই হোক। দুর্নীতিবাজদের ধরতে সব রকমের ব্যবস্থা রয়েছে।তালিকার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘তালিকা এখানে বড় কথা নয়। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত অভিযান চলবে। আর এই অভিযান থেমে যাবে বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এবার সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে। আমরা মাদকবিরোধী অভিযান করেছি এবং তা অব্যাহত আছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চলবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতারাই অভিযান নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছেন। আবার এদের সহযোগী হিসেবে আমলা ও পুলিশের অনেকের নাম বেরিয়ে আসায় অভিযান বন্ধের পাঁয়তারা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আওয়ামী লীগের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই এই অভিযানের পক্ষে।