সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেও নদী দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালে দেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৪৯ জন। যা গতবছর দখলদারের এই সংখ্যা ছিলো ৫৭ হাজার ৩৯০ জন।
মঙ্গলবার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
এতে জানানো হয়, প্রতিটি বিভাগেই পেশি শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে নদীর মধ্যে বা ফোরশোরে বড় বড় কিছু অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা যায়নি। এমনকি সরকারি স্থাপনাও সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং লজিস্টিক ও অর্থ সংকটের কারণে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
রাজধানীর পল্টন এলাকায় অবস্থিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয়ে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সরাসরি ও জুম দুইভাবে বক্তারা এ অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ মতবিনিময় সভা যখন চলছিল তখন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক সচিব এএসএম আলী কবীরকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নেন ড. মুজিবুর রহমান।
সভায় তিনি বলেন, আমরা ২০১৯ সালের নদী দখলদার ও উচ্ছেদের প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। ওই বছর নদীর দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। এরমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে। যা নদী দখলকারীর ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০২০ সালের তথ্য এখনো পুরোপুরি সংগ্রহ করা হয়নি। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি তাতে সারা দেশের নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৪৯ জন। তিনি বলেন, নদী দখলদার চিহ্নিত করার কাজ অব্যাহত থাকবে।
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীগুলোর অনেক যায়গা বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নেয়ার চিত্র দেখা গেছে। সরকারের নদী রক্ষার চার হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প শুরু হয়েছে তা বাস্তবায়নে জটিলতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ সেখানে বিদ্যুৎ ও সোলার প্ল্যান্ট, সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবুও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদী দখলের মাত্রা এখন কমেছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়ে যে প্রস্তাব এসেছে তা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী উদ্ধারের পক্ষে রয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নদীকে লালন করা জরুরি। নদী আমাদের ইতিহাসের অংশ। উন্নয়ন মানেই পরিবেশ ধ্বংস নয়। পরিবেশ ও অর্থনীতি দুটো মেনে নিয়ে নদী রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য শুধু প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। তিনি বলেন, দখলদাররা যা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি দখল করে নিচ্ছে। নদী রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে টেকসই হবে।
নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে উচ্ছেদ কার্যক্রমে সরকারি সংস্থাগুলোর কাঙ্খিত সহযোগিতা না করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালে উচ্ছেদ অভিযানে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা বা আশানুরূপ ছিলো না। তবে আগের তুলনায় অগ্রগতি হয়েছে। উচ্ছেদ কার্যক্রমে অপ্রতুল অর্থায়ন করা হয়েছে। উচ্ছেদের ক্ষেত্রে অর্থায়নে চরম গুরুত্বহীনতা ও অবহেলা লক্ষণীয়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে নদীর অবৈধ দখলদারের সংখ্যা আট হাজার ৮৯০ জন। এরমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে এক হাজার ৪৫২ জনকে। এসব জেলায় দখলদারের ৫০ শতাংশ উচ্ছেদ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে নদী দখলদার ৪ হাজার ৭০৪ জন। এরমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ২৩০ জনকে। খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ২৪৫ জন নদী দখলদার রয়েছেন। এরমধ্যে চার হাজার ৮৯০ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বরিশাল বিভাগের পাঁচ হাজার ৬১১ জন দখলদারের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৭৯৩ জনকে। সিলেট বিভাগের দুই হাজার ৪৪ জন নদী দখলদার রয়েছেন। তাদের মধ্যে উচ্ছেদ হয়েছে ৫৭৬ জন। ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে চার হাজার ৮৪৮ জন নদী দখলদারের মধ্যে এক হাজার ৭০৭ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রংপুর বিভাগের নদীগুলোতে দুই হাজার ৭৬০ জন দখলদার রয়েছে। এর মধ্যে ৮১৩ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের দুই হাজার ৬৯৩ জন দখলদারের উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪১ জনকে।
মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন, অবনৈতিক সদস্য শারমীন সোনিয়া মুরশিদ, আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।