জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ইসলামপুর রোড, বাংলাবাজার, সদরঘাট এলাকাজুড়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ও যানজট সৃষ্টি করে টোল আদায়ের নামে প্রকাশ্যেই চলছে চাঁদবাজী। প্রতিদিন ভোর সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দূরগামী মালবাহী ট্রাকসহ অন্য যানবাহন থামিয়ে তারা তুলছে এ চাঁদা। প্রশাসনের লোকজন দেখেও না দেখার ভান করছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
রজমিনে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নাম সংবলিত পোশাকে বেশ কয়েকজন যুবক হাতে লাঠি ও মোটা রশিদ বই নিয়ে নিয়মিত টোল ফি আদায় করছে। ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র সরদঘাটে প্রতিদিন সহস্রাধিক গাড়ির চলাচল, যানজট যেন লেগেই থাকে। সেই যানজটের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে টোল আদায় করা মানুষের ভোগান্তিকে করেছে দ্বিগুণ, যানজটকে করেছে দীর্ঘায়িত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদা আদায়কারী একজন বলেন, আমরা এখানে দিনমজুর। আগে সদরঘাটে কাজ করতাম, এখন এখানে কাজ ই করি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। দুই শিফটে আমরা এখানে কাজ করি। প্রতি শিফটে একেকজন ৩০০ টাকা পেয়ে থাকি। কে বা কাদের কাছ থেকে এই মজুরি পেয়ে থাকেন এমন প্রশ্নের জবাবে, কাজী মনির নামক এক ব্যক্তির নাম উঠে আসে। চাঁদা আদায়কারী রাজিব বলেন, মিনহাজ এন্টারপ্রাইজের লোক আমরা। সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমতি প্রাপ্ত আমরা। আমাদের হাতে ১০০ পাতার রশিদ বই রয়েছে। প্রত্যেকের রশিদ বই ই বিলি হয়ে যায়। কখনো কখনো একজনেই ৩/৪ টা বই বিলি করে থাকি। এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, একই ড্রেস পরিহিত প্রায় ২০/৩০ জন যুবক এদিকসেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
কাজী মনিরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ছেলেরা না বুঝে আমার নাম বলেছে। আগে এক সময় রাজনীতি করতাম, তাই সবাই আমাকে চিনে, আমার নাম বলে। আমি এর সাথে জড়িত না, বর্তমানে আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি। মেয়র তাপসের চাচা, গোপালগঞ্জের আলম শেখ এটা ইজারা নিয়েছে, রাজস্ব টোল আদায়ের জন্য। তিনি আমারে বলছিল মনির এই দিকটা একটু দেখিস। একসময় ছাত্রনেতা ছিলাম, চেনা জানা আছে, এতটুকু ই। তাছাড়া এর সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নাই।
চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, চাঁদা আদায়ের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। তবে এলাকা ভিত্তিক ইজারা দেওয়া হয়েছে সিটি কর্পোরেশন থেকে। টোল আদায়ের নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। কোন গাড়িতে কত টাকা টোল নেওয়া যাবে নির্ধারিত। অতিরিক্ত টাকা নেওয়া যাবে না। রিকশা-ভ্যান থেকে কোনও টোল আদায় করা যাবে না। যদি যন্ত্রচালিত যানবাহন ব্যতীত অন্য কোন যানবাহন থেকে টোল বলে টাকা নেওয়া হয়, তবে তা বেআইনী হবে এবং চাঁদা বলে গণ্য হতে পারে।
বরিশাল থেকে আগত জহির জানান, আমি দীর্ঘ দিন বাড়িতে থাকার পর আজ ঢাকা আসলাম। বাড়ি থেকে অনেক সরঞ্জাম, খাবার নিয়ে এসেছি। বাংলা বাজার ওভার ব্রীজের নিচে দুজন রিক্সা থামিয়ে ২০ টাকা নিয়ে গেল। কিসের বা কেন টাকা দিব, সেই প্রশ্ন করার সুযোগ দিল না। হাতে তাদের লাঠি ছিল, খুব দ্রুত টাকা টা নিয়ে গেল।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী রিয়াজুল বলেন, প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় টাকা দিয়ে যেতে হয়। টাকা দিতে দেরি হলে শারীরিকভাবে আঘাত করে। সামান্য টাকার জন্য সিএনজির গ্লাস লাটি দিয়ে আঘাত করে, কোন সময় ভেঙেও ফেলে গ্লাস। মাঝ রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি করে। মাঝ রাস্তা দিয়ে বেপরোয়া ভাবে ছুটাছুটি করে তারা, এতে আতঙ্কিত হয় সাধারণ যাত্রী। পুলিশের সামনেই হয়রানি করছে আমাদের অথচ নিশ্চুপ প্রশাসন। আমার ধারণা মোটা অংকের টাকা নিচ্ছে পুলিশ অথবা পুলিশ নিজেই এর সাথে সম্পৃক্ত।
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে ব্যাবসায়ী মৃদুল জানান, দীর্ঘ ছয়মাস যাবত এখানে এমন বেপরোয়া চাদাবাজী আমি দেখে আসছি। দোকানের সামনে এমন অনিয়ম আমাদের বদনামের কারণ বলে মনে করি। তাছাড়া দোকানের সামনে যানজটের কারণে ক্রেতারাও খুব একটা আসে না দোকানে।সিএনজি, ভ্যান, ট্রাক এমনকি কুলিদের থেকেও নিয়মিত ১০-৫০ টাকা টোল নিচ্ছে তারা।
পিকাপ চালক সাদেক জানান, টঙ্গী পেরিয়ে ঢাকার সীমানায় প্রবেশ করলেই প্রতি ট্রাক থেকে টাকা আদায় শুরু হয়। এই রুট থেকে সদরঘাট আসা পর্যন্ত ধাপে ধাপে বিভিন্ন অংকের চাঁদা দিতে হয়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশও এই টাকায় ভাগ বসান। চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমরা। সদরঘাটেও ঢুকতে হয়েছে ৫০ টাকা চাঁদা দিয়ে।
বাংলাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক পলাশ জানান, তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে এই টোল আদায় করে। আমরা নিয়মিত ই দেখি এসব, তবে তাদের বৈধতা কতটুকু তা আমাদের অজানা। আমার ডিউটিরত এলাকায় ধরা পড়লে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি। তবে আটক করলে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ তাদের ছাড়িয়ে নেই।
কোতোয়ালি থানার পুলিশ ইনচার্জ মিজানুর রহমান জানান, আমরা এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। তবে সিটি কর্পোরেশন যদি এসব কর্মকান্ডকে অবৈধ বলে আমাদের চিঠি দেই তবেই আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। তাছাড়া আমরা এটাকে সিটি কর্পোরেশনের আইনী রাজস্ব টোল বলেই জানি।