শাহজাহান সিরাজ, কয়রা প্রতিনিধিঃ সুন্দরবনে গোল গাছে পাতা মরা রোগের কারনে নষ্ট হচ্ছে গোলপাতা। অভয়ারণ্যসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মন পাতা নষ্ট হচ্ছে। এতে গোল গাছের প্রজনন নষ্ট হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নতুন নতুন কুপও বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, যেসব স্থানে গোলপাতার কুপ (প্রজনন ক্ষেত্র) রয়েছে সেসব স্থানে গোল গাছের পাতা মরে যাচ্ছে। এক জায়গায় অধিক গাছ হওয়ার কারনে এসব গাছের পাতার এমন অবস্থা। কোন কোন গাছে মাইজ পাতা (মাঝখানের শিশু পাতা) বাদে সব পাতাই নষ্ট হয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বাওয়ালীরা বলছেন, পাতা না কাটার কারনেই নষ্ট হচ্ছে। এতে ফল প্রদানের পরিমানও কমে যাবে গাছের। একসময় এসব কুপ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্খা করছেন তারা।
ইসমাইল হোসেন নামে এক বাওয়ালী বলেন, আগে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবীরা সারা বছর কিছু না কিছু আয় করতে পারত। এখন সেই অবস্থার সংকুচিত হওয়ার কারণে শিকারীদের পরিমান বেড়েছে। ফলে গত কয়েক বছরে যে পরিমান হরিণ শিকারী ধরা পড়েছে অতিতে এর পরিমান এত ছিল না। সুন্দরবন বনজীবী ব্যবসায়ী ফেডারেশনের সভাপতি মীর কামরুজ্জামান বাচ্চু বলেন, এক সময় সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জেই শুধু তিনটি কুপ থেকে গোলপাতা আহরণ করা হতো। বর্তমানে একটি কুপ থেকে গোলপাতা কাটা হয়। বাকি কুপগুলোতে গোলপাতার বংশ বিস্তার কমেছে। পাতা মরে যাচ্ছে। গাছ পরিস্কার না করার কারণে ফল দেওয়ার পরিমানও কমেছে। ফলে এক সময় এসব গাছ মরে যাবে। তখন গাছের প্রজননও বৃদ্ধি পাবে না। তিনি বলেন, গোলগাছ নারকেল, খেজুর, তাল ও কলা জাতীয় গাছের মত। ঝোড়া বা পরিস্কার করা না হলে ফল প্রদানের পরিমান কমে যায়। বর্তমানে সুন্দরবনে গোলগাছের ক্ষেত্রটাও একই রকমের। উপকূলের মানুষের মধ্যে গোলগাছের ব্যবহার কমছে। পাতার জোগান না থাকায় মানুষ টিনের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। অন্যদিকে একসময় বারো মাসই গোলপাতা আহরন করা যেত। তখন কিন্তু প্রজনন বাড়ত। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এসব কুপ নষ্ট হতে বাধ্য।
তিনি আরও বলেন, বন বিভাগের তদারকি বাড়লে বাওয়ালীরা গোল গাছের শুধুই পাতাই কাটবে না সাথে সাথে গাছ পরিস্কার করে দেবে। তখন গাছের পাতা উৎপাদনের সক্ষমতাও বাড়বে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় অফিস সূত্র জানিয়েছে, এ বিভাগের আওতায় এখন মাত্র ২টি কুপ থেকে চলে গোলপাতা আহরণ। পূর্বে এ বিভাগ থেকে আড়– শিবসা, শিবসা এবং ভদ্রা এ তিনটি এবং সাতক্ষীরা রেঞ্জের সাতক্ষীরা কুপ থেকে গোলপাতা আহরণ করা হতো। বর্তমানে তিনটি স্থানই অভয়ারন্য ঘোষনার মধ্যে পড়েছে। ফলে বর্তমানে এসব কুপ থেকে আর গোলপাতা আহরণ করা হয় না। যে কারনে গোল গাছ পরিস্কার না করায় মরা পাতার পরিমান বাড়ছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, আগে প্রায় ১ হাজার বাওয়ালী গোলপাতা আহরণ করতো। এখন তা কমে আড়াইশ’তে নেমে এসেছে। গোলগাছের পাতামরা রোগের বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ফুল এবং ফলের জন্য গোলগাছ পরিস্কার করা জরুরী। না হলে নষ্ট হয়ে যাবে। পাতা না থাকলে গাছের বৃদ্ধি পাওয়ার হারও কমে যাবে। বাওয়ালীদের নির্দেশনাই থাকে যে পাতা কাটার সাথে সাথে গাছ পরিস্কার করে দেওয়া। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয় না। তারা কোন রকমে পাতা কেটে নিয়ে চলে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের তীক্ষè ধারালো দায়ের আঘাতেও মাইজ পাতা বা ফলের ক্ষতি হয়।
সেক্ষেত্রে ওই গাছ আর ফল উৎপাদন করতে পারে না। এজন্য উচিত হবে-বনবিভাগের কর্মকর্তারা বাওয়ালীদের প্রশিক্ষন দিয়ে তবেই পাঠানো। তাহলে পাতা কাটলে অসুবিধা হবে না। তিনি বলেন, সুন্দরবনের বৈশিষ্টই হচ্ছে এক জায়গায় নষ্ট হলে অন্য জায়গায় বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, কিছু গোলপাতা ঝড়ের কারনে বা অন্য কারণে নষ্ট হতেই পারে। পাতা কাটলে পাতা বাড়ে একথা ঠিক তবে এখন গোলপাতার চাহিদা বাইরে কম। একসময় ১০ লক্ষ টন পরিমান পাতা আহরণ করা হতো। এখন তা কমে ২ লক্ষ টনে নেমেছে। যে কারণে অনুমতিও কম দেওয়া হয়। তিনি বলেন, সুন্দরবনের কোন গাছ মানুষ লাগায়নি। ফলে এ বনের গাছও নিজস্ব নিয়মেই তার বিস্তার বৃদ্ধি করবে।