দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার ওপর দিয়ে বয়ে চলা ১৩ নদীর দশ নদীতে এ বছর শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে সবথেকে বেশি। ২০০৪ সালের এপ্রিলের তুলনায় এ বছরের এপ্রিলে এসব নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৭ ডিএস/মি থেকে ২০.০৫ ডি এস/ মিঃ পর্যন্ত। একই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এই অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমান। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এই তিন জেলায় সর্বোচ্চ ১৬ডিএস/মি লবণাক্ত জমির পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে ২০,০৩ হাজার হেক্টর। যা পরিবর্তন ঘটাচ্ছে এই অঞ্চলের কৃষি ও মানুষের জীবনযাপনে।
খুলনার বটিয়াঘাটার জলমা এলাকার বিলে নিজ জমিতে মাটি কাটছেন কৃষক তুলশী মন্ডল। পাশে বসেই দড়ি পাকাচ্ছেন গোবিন্দ মন্ডল। তাদের দাবি দিন দিন বাড়ছে লবণ। লবণের কারণে আগে যে ফসল চাষ করত এখন তা করতে পারছেন না। হাইব্রিড ফসল চাষ করলেও পানির অভাবে ফলন ভাল পাওয়া যাচ্ছে না বলছেন তারা। তুলশী মন্ডল বলেন, এ বছর তরমুজে লাভ হয়নি সেচের পানি দিতে না পারায়।
দশ বছরে অতিমাত্রার লবনাক্ত জমি বেড়েছে ২০ হাজার হেক্টেরের বেশি বদলে যাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা
বয়স্ক গোবিন্দ মন্ডল বলেন, আগে আমন চাষ করতাম, নানা ধরনের ভাইটেল ধান চাষ করতাম। এখন তা আর হয় না সব ইরি চাষে ঝুঁকছে।
অপর এক চাষি নিরঞ্জন ওঝা বলেন, নানা ধরনের ফসল এখন আর চাষ হয় না। নতুন ফসল নতুনভাবে চাষ করলেও লবণের কারণে ফলন হচ্ছে না আশানুরূপ।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বলছে খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার ভিতর দিয়ে বহত ১৩ বড় নদীর ১০ নদীর পানিতে এবছর শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততা বেশি পাওয়া গেছে। বাগেরহাটের মধুমতি, পশুর, দড়াটানা, খুলনার রূপসা, শৈলমারী, ভদ্রা, কাজীবাছা, সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ, কাকশিয়ালী, মরিচান নদীতে ২০০৪ সালের তুলনায় ২০২১ সালে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৭ ডিএস/মি থেকে ২০.০৫ ডিএস/মি:। একই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এই অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততাও। ২ হাজার সালে এই তিন জেলায় সর্বোচ্চ ১৬ডিএস/মি লবণাক্ত জমি ছিল ৪৮.৩৬ হজার হেক্টর সেখানে ২০০৯ সালে তা দাড়িয়েছে ৬৮.৩৯ হাজার হেক্টরে। শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি কমে যাওয়া ও উজানে মিষ্টি পানির প্রবাহ কম থাকা এবং ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসে লবণাক্ত পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা তৈরীতে বাড়ছে লবণাক্ততা বলছেন খুলনা বিভাগীয় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বিভাগীয় কার্যালয়, খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব এই অঞ্চলের লবণাক্ততা বাড়ছে। আরও বড়ো কারণ হচ্ছে ফারাক্কা বাধের কারণে উজানে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসে লোকালয়ে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা তৈরী হওয়া। এ সকল কারনেই এখানকার লবণাক্ততা বাড়ছে। আর এখানকার কৃষকরাও এখন লবণাক্ত জমিতে যে সকল ফসল ভাল হয় তাই চাষ করছেন।
জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি অবৈজ্ঞানিকভাবে বাঁধ তৈরী করায় নদীর গভীরতা কমে যাওয়া ও প্রাকৃতিক ড্রেনেজ সিষ্টেম নষ্ট করার কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জোয়ারে সমতলে লবনাক্ত পানি প্রবেশ করে জলাবদ্ধতা তৈরী করছে। আর এই জলবাদ্ধতাই বাড়াচ্ছে লবণাক্ততা বলছেন গবেষকরা। লবণাক্ততা কমাতে টাইটেল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বাস্তবায়নের কথা বলছেন তারা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, লবণপানি লোকালয়ে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। এবং প্রাকৃতিক ড্রেনেজ সিষ্টেম টাকে আরও ডেভলপ করতে হবে তাহলে এই অঞ্চলের লবণাক্ততা কমানো যাবে। আমাদের বাঁধগুলো বিজ্ঞান সম্মত না হওয়ায় নদীতে পলি জমে। আবার ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসে বাঁধ ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে কৃষি জমিতে। যা দীর্ঘ জলাবদ্ধতা তৈরী করছে ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে। এছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। লবণাক্ততা পুরোপুরি নিরসন সম্ভব না হলেও টাইটেল রিভার ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।
সময়ের সাথে সাথে নানাবিধ কমছে এই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষি জমি। শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে হাইব্রিড ফসল চাষ ও মিশ্র চাষের মাধ্যমে যতটা উপকার পাওয়া যাচ্ছিল তাও আর পাওয়া যাবে না বলছে কৃষকরা। ফলে অদূর ভবিষ্যতে দেখা দিবে বিপর্যয়।