দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল ৩টা পর্যন্ত (সাত ঘণ্টায়) সারাদেশে ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে। ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্রগুলোয় চলছে ব্যালট পেপার গণনা।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিবেশ, ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ।
দলটির দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনবিরোধী অপপ্রচার, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টার পরও সারা দেশে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক। এটি গণতন্ত্রের জয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন করার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন দিয়েছিল, সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে।’
এদিকে আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এর পর্যন্ত সাতটি কেন্দ্রে ভোট বাতিল হয়েছে এবং জাল ভোট দেওয়া কিংবা জাল ভোটে সহায়তা করার জন্য ১৫ ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি বা দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিংসহ যারা জাল ভোট দিতে গেছেন তারাও রয়েছেন।
ইসি জানায়, ছোটখাটো ৩০/৩৫ জায়গায় ভোট কেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। কোথাও ভোট কেন্দ্রের পাশে ককলেট বিস্ফোরণ হয়েছে।
এ ছাড়া আমাদের দুইজন প্রিজাইডিং অফিসার দায়িত্ব পালন করার সময় মারা গিয়েছেন একজন। গতরাতে দায়িত্বপালনকালে তিনি মারা যান। আরেক আজ কে জামালপুরে একজন হার্ট অ্যাটাক করে মারা গিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ঢাকা-১৬ আসনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে।
ইসি সচিব জাহাংগীর আলম জানান, মোস্তাফিজুরের প্রার্থিতা বাতিল হলেও চট্টগ্রাম-১৬ আসনে ভোট চলমান থাকবে। এই আসনে বাকি প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে সারাদেশের ৩০০টি আসনের মধ্য ২৯৯টি আসনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। মোট ব্যালটের ৯৩ শতাংশ ব্যালট পেপার সকালে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
ইসি সচিব জাহাংগীর আলম এর আগে জানান, দুপুর ১২টা ১০ পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে ১৭ ভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ ভাগ, সিলেটে ১৮ ভাগ, বরিশালে ২২ ভাগ, খুলনায় ২১ ভাগ, রাজশাহীতে ১৭ ভাগ, ময়মনসিংহে ২০ ভাগ ভোট গ্রহণ হয়েছে। আটটি বিভাগে গড়ে ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
মুন্সীগঞ্জে একজন নিহত হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে ইসি সচিব বলেন, মুন্সীগঞ্জে একজন নিহত হওয়ার ঘটনাটি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে নয়, বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের জানিয়েছেন, এটি ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ওই ব্যক্তি অন্য কোনো একটি মার্ডার মামলায় আসামি ছিলেন। সে এলাকায় আসায় ছুরিকাঘাতের শিকার হয়ে মারা গেছেন বলে পুলিশ সুপার আমাদের জানিয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা তদন্ত করলে আমরা জানতে পারব।
নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনায় মোট ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়ে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সম্পাদক বা অনুরূপ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের সঙ্গে সভা করে বা যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা দায়িত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ৭ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকবে। গতকাল থেকে বন্ধ রয়েছে মোটরসাইকেল চলাচল। তবে ভোটারদের চলাচলের সুবিধার্থে প্রাইভেট কার ও গণপরিবহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল থাকবে। ইসির অনুমোদনপ্রাপ্ত মোটরসাইকেল ও যান চলাচল এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।
সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের আগে নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে আসনটির ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে। ফলে আগামীকাল ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত য়। এবার নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরমধ্যে রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৫৩৪ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েন ৪৩৬ জন।
এবার নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। হাইকোর্ট থেকে ৩ জন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় দলটির প্রার্থীর সংখ্যা ২৬৬ জন। জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন, তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ ২৮টি রাজনৈতিক দলের মোট প্রার্থী সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৪ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৬ জন। এ ছাড়া নির্বাচনে ৯০ জন নারী প্রার্থী ও ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জাতীয় পাটি, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, তৃণমূল বিএনপি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল) ও গণতন্ত্রী পার্টি প্রার্থী দিয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা চূড়ান্ত করে তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার সংস্থাটির প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ জন। নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৮৪৯ জন। এবারের তালিকায় নতুন ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি ৫৪ লাখ। এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশে ভোটারের সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৪১ লাখ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ১১ লাখ এবং নবম জাতীয় নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৮ কোটি ১০ লাখ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের জন্য এবার চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ১৪৮টি। ওইসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪টি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছাবে। অবশ্য ৪ হাজারের বেশি দুর্গম ভোটকেন্দ্রে যাতায়াত পথ বিবেচনায় আগের দিন ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে গত বুধবার নির্বাচনি মাঠের নিরাপত্তায় মাঠে নেমেছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে, গত ২৯ ডিসেম্বর মাঠে নামেন পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ডের সদস্যরা। তারা নির্বাচনি মাঠে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করছেন। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও আনসার সদস্যরা শুক্রবার মাঠে নেমেছেন। মাঠে নেমেছেন ৬৫৩ বিচারিক হাকিম।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গত বৃহস্পতিবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে সাংবাদিকদের জানান, প্রায় ৮ লাখ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী পোলিং কালেকশনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবেন। তারা ভোটগ্রহণ করবেন। আরও ১ লাখ স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। ৯ লাখ আমাদের প্রস্তুত আছে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সংস্থাগুলো-পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, র্যাব, বিজিবি সব মিলিয়ে ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মাঠে আছেন। মাঠে থাকবেন ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ আসনে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।