আন্তর্জাতিক ডেস্কঃইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। সর্বোচ্চ নেতা খামেনির পরেই তার স্থান। এমনকি প্রেসিডেন্ট আর সরকারের চেয়েও ইরানে তার কথার মূল্য ছিল বেশি। সোলেইমানিকে অনেকে দুনিয়ার এক নম্বর জেনারেল বলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বুশ আর ওবামা তাকে হত্যা পরিকল্পনা করে পিছিয়ে আসলেও ট্রাম্প কেন তাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন?
ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী সেনা কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পরিণতি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে গভীর উদ্বেগ শুরু হয়েছে। তেহরান কঠোরতম প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘অপরাধীদের জন্য ভয়াবহ প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে।
দেশের বাইরে তথা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান যে তার সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে তার পেছনে মূল ব্যক্তিটি ছিলেন কাসেম সোলেয়মানি। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনের মতো দেশগুলোতে তেহরানপন্থী যে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো এখন পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছে, তিনিই ছিলেন এর রূপকার। এছাড়া ইরানিদের কাছে সোলেইমানির সম্মান অনেক।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্ষমতা বিস্তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্র ইসরায়েলের এক নম্বর টার্গেট ছিলেন ইরানের এ ক্ষমতাধর জেনারেল। ইসরায়েলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, বারাক ওবামা পর্যন্ত তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেও পরিণতির কথা ভেবে পরে পিছিয়ে আসেন। কিন্তু ট্রাম্পের এমন দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তের নেপথ্যে অন্যকিছু খুঁজে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
সোলেইমানি হত্যার পর তাই সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটদের সম্ভাব্য প্রার্থী জো বাইডেন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘একটা বারুদের বাক্সে ডিনামাইট ছুড়ে দিয়েছেন’। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বড় ধরনের যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলাম।’ বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাট তার মতোই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি সোলেইমানিকে হত্যায় বিমান হামলার বিস্তারিত তথ্য এবং হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আইনপ্রণেতাদের জানাতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপে যাওয়ার জন্য নিয়ম অনুযায়ী কংগ্রেসের পরামর্শ ও অনুমোদন না নেয়ায় ট্রাম্পের হামলার নির্দেশ নিয়েও প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
হামলার পর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আজকের এ বিমান হামলা নতুন করে সহিংসতা ছড়ানোর উসকানি দিয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই এবং কোনো অনুমোদন না নিয়েই সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে হামলা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বের এমন কোনো সহিংসতা ছড়ানো উচিত নয় যা থেকে ফিরে আসা যায়।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সোলেইমানি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু হওয়া সত্ত্বেও তার পূর্বসূরিরা যে ঝুঁকি নিতে চাননি, ট্রাম্প এখন কেন তা নিলেন? পেন্টাগন বলছে, সোলেইমানি ইরাকে মার্কিন কূটনীতিক ও সৈন্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। সুতরাং আগে থেকেই তাকে হত্যা করে সেসব পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হলো। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্নকথা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন সময়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটালেন, কিছুদিন আগেই তিনি মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে অভিশংসিত হয়েছেন। এছাড়া আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই আসন্ন নির্বাচন আর অভিশংসন থেকে দেশের মানুষের মনোযোগ ফেরাতে চিরবৈরী ইরানের বিরুদ্ধে হামলার এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক বলে বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা ইতোমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন।
তাছাড়া বিদেশি বন্ধুদের কাছে নির্বাচনে সহযোগিতা চেয়ে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিশংসিত হওয়া ট্রাম্পের নির্বাচনে জিততে এ রকম বড় কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। তার চাহিদা মতো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বেশিরভাগ গণমাধ্যমে প্রাথমিকভাবে এ ঘটনাকে ইতিবাচক এক অভিযান হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ট্রাম্পও বাগদাদে হামলার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু মার্কিন পতাকার ছবি পোস্ট করেন। মার্কিনিদের জাতীয়তাবাদ জাগাতেই এবং নিজেকে হিরো প্রমাণ করতেই তার এমন চাল।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি জুলিয়ান বার্গার লিখেছেন, নভেম্বরের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সোলেইমানিকে হত্যার এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি মনে করছেন, ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার যে ঘটনা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের প্রচারণার প্রধান একটি বিষয় হয়ে উঠেছিল এবং তাকে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এনেছিল ট্রাম্প হয়তো বিরুদ্ধ এ সময়ে সেরকমই কিছু করে আবার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চাইছেন।
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন বলছেন, সোলেইমানিকে হত্যার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আগের। কিন্তু এতদিন ধরে সেই অপেক্ষা প্রশমন করে রাখলেও ঠিক এ মুহূর্তে কেন এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, এটা একটা বড় প্রশ্ন। তার কারণ হতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো মনে করেছেন সোলেইমানিকে হত্যা করলে তার জন্য যে ঝুঁকি তৈরি হবে তার চেয়ে সুবিধার পাল্লা ভারি। এতে নির্বাচনে ফায়দা তুলতে পারবেন তিনি।
বিবিসির ওই অভিজ্ঞ সাংবাদিক বলছেন, ‘তিনি (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প) হয়তো মনে করেছেন অব্যাহত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় ইরান দুর্বল-একঘরে হয়ে পড়েছে। দেশের ভেতরে যে প্রচণ্ড অসন্তোষ শুরু হয়েছে তাতে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হলেও, ইরান বড় কোনো হুমকি তৈরি করতে পারবে না।’ কিন্তু ইরান এ বিষয়ে কীভাবে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
খামেনির সবচেয়ে আস্থাভাজন জেনারেলদের একজন সোলেইমানি ১৯৯৮ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়াপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয় ইরানের। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত অঞ্চলে ইরানের প্রভাব-বলয় গড়ে ওঠে। যা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলসহ তেহরানের বিরুদ্ধ-শক্তির। তাই খামেনির আস্থাভাজন একজন শীর্ষ জেনারেল তথা নেতার এভাবে নিহত হওয়ার প্রতিশোধ নেবেই তারা।
বিবিসির জেরেমি বোয়েন বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ইরান দুর্বল’ বলে তারা তেমন কিছু করতে পারবে না বলে মন্তব্য করে নির্ভার থাকার চিন্তা করছেন, বাস্তবে তা হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, এ শঙ্কার সন্দেহ গত বছর থেকেই চলছে কিন্তু তলে তলে সেই যুদ্ধ এড়ানোর একটা চেষ্টাও আবার চলছিল। তাই কিছুটা শান্ত ছিল। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ড উত্তেজনাকে আরও উসকে দিল।
তিনি বলছেন, ‘কূটকৌশল বা পরিকল্পনাকারী হিসেবে সোলেইমানি ছিলেন খুবই ক্ষুরধার। সুতরাং তাকে কখনও হত্যা করা হলে কী করতে হবে তেমন পরিকল্পনাও হয়তো তিনি করে গেছেন। ইরান যে তার হত্যার একটা জবাব দেবে, তা নিশ্চিত। সোলেইমানি এতদিন ধরে দেশের বাইরে ইরানের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি করেছেন, তা টিকিয়ে রাখার সবরকম চেষ্টা ইরান করবে।’
বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা লিস ডুসেট মনে করছেন, এতদিন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছিল কিন্তু পারমাণবিক চুক্তি টিকিয়ে রাখতে ফ্রান্স দুই দেশের মধ্যে একটা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সোলেইমানি এবং ইরাকি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের প্রধান আবু মাহদি আল মোহানদিসকে হত্যার পর সেই যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা ধসে পড়বে, সন্দেহ নেই।
কিন্তু কীভাবে ইরান প্রতিশোধ নেবে, তা পরিষ্কার অনুমান করা এখন শক্ত। তেহরানে ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক হচ্ছে। সেখান থেকেই হয়তো একটা ছক তৈরি হবে। বদলা নেয়ার নানা রাস্তা আর উপায় ইরানের আছে। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক সদস্য কার্সটেন ফনটেনরোজকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ান লিখেছে, ইরানের এ বদলা হয়তো হবে দীর্ঘমেয়াদী এবং নানামুখী।
বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা লিস ডুসেট বলছেন, ইরাকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে কিছু হামলা চালাবে, কিন্তু ইরান হয়তো ‘উপযুক্ত সময় এবং স্থানের জন্য অপেক্ষা করবে।’ তিনি বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এমনকি পশ্চিম আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকাতেও মার্কিন স্বার্থ ও নাগরিকরা হামলার মুখে পড়তে পারেন এবং এ ঘটনা বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে। ‘ইরান এমন একটি বার্তা দিতে চাইবে যে, মার্কিনিরা কোথাও নিরাপদ নয়।’
সূত্র: বিবিসি, গার্ডিয়ান, মিডল ইস্ট আই, মিডল ইস্ট মনিটর