সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ফিরে: পাহাড়, সাগর, ঝর্ণা দেখা হয়েছে। শুধু ঘোরাফেরার তালিকায় ছিল না হাওড়। কয়েক বছর ধরে শুনছিলাম যে হাওড়ে ভেসে বেড়ানো নৌকার চালে বসে বৃষ্টির মৃদু ছন্দ শুনতে নাকি অপরূপ লাগে। এই অনুভূতি, অভিজ্ঞতা না হলে নাকি বিশ্বাস করাই কষ্টকর। সত্যি মিথ্যা জানতে পৌঁছে গেলাম সেই অভিজ্ঞতা নিতে, প্রমাণ পেলাম সেই অসাধারণ অনুভূতির। চারদিকে জলে ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপে নৌকাগুলো যেন একেকটা বাড়ি, নেই কোনো রাস্তাঘাট। ভরা বর্ষা যেন যৌবন পুরোটা ঢেলে দিয়েছে হাওড়ে।
সুনামগঞ্জ জেলার ৫১টি বিল মিলে টাঙ্গুয়ার হাওড়। বর্ষায় ভ্রমণে এটি পর্যটকদের প্রথম পছন্দ। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা নয়নাভিরাম জলরাশি হচ্ছে এর আসল সৌন্দর্য। এছাড়া টেকেরঘাট ও নীলাদ্রি লেকে সন্ধ্যা কাটান পর্যটকরা। সাথে আছে শিমুলবাগান, বারিকটিলা, জাদুকাটা নদীসহ ভারতের মেঘালয়ের বড় বড় পাহাড়গুলো। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিশেছে হাওড়ে।
একটা সময় ছিল, এই হাওড়ে ভ্রমণ, থাকা সবকিছুই ছিল বেশ কষ্টকর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য ও চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে এখন হাওর ভ্রমণে মিলছে নানা সুযোগ-সুবিধা। আর এগুলোই ভ্রমণকে করেছে সহজ ও আরামদায়ক। পর্যটকদের জন্য এখন মেলে বিভিন্ন মানের হাউসবোট। বোটগুলোতে থাকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
নিজের প্রথম হাওর ভ্রমণ। তাই চাচ্ছিলাম না কোনো খারাপ অভিজ্ঞতার শিকার হই। তাই আগে থেকেই সব বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলাম। হাওড়ে আমাদের বাসস্থান ‘জলনিবাস’হাউসবোট। উন্নতমানের হাউসবোটগুলোর তালিকায় এটি প্রথম কাতারে পড়ে।
সাধারণত ভালো মানের হাউসবোটগুলোতে থাকে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা (হাওড়ের মাঝে জেনারেটর), কেবিনের সঙ্গে অ্যাটাচ ওয়াশরুম, দক্ষ সুকানি (মাঝি), পরিপাটি লবি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছাদ, দক্ষ ট্যুর গাইড ও আপ্যায়ন।
হ্যাঁ, ভাবতে পারেন আমি খাবারের কথা কেন বলছি না। এটা আসলে বলে বোঝানো সম্ভব না। কোথাও ঘুরতে গেলে মূলত সবার আগে খাবার নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু টাঙ্গুয়ার বিলাসে খাবারের আয়োজন ছিল ভিন্ন ধরনের। সকালের খিচুড়ি, ডিমের কোপ্তা, আঁচার এখনও মুখে লেগে আছে। দুপুর-রাতের মাছ, মুরগি, হাস, সবজি, ভর্তা, ডালের স্বাদ বলার অপেক্ষা রাখে না। হাউজবোটের রাঁধুনি তার পরম যত্নে ও এক মুখ হাসিতে প্রতি বেলার খাবার খাইয়েছেন। আর সারাদিনের জন্য আনলিমিটেড চা-তো ছিলই।
বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা হয় টাঙ্গুয়ার হাওড়ে । বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নৌকা, হাউসবোটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হাওড়ে ভাসলেই দেখা যায়- কেউ নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে, সারি সারি করচগাছের ফাঁকে ফাঁকে হ্যামকে ঝুলছে, ছবি তুলছে, উল্লাস করছে, করচগাছের ছায়ায় নৌকায় বসে কেউ শুনছে হাসন রাজার গান, কেউবা শাহ আবদুল করিমের।
রাতের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি মনে রাখার মতো। দূর থেকে হাউসবোটগুলোর ঢিবি ঢিবি আলো হাওরের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। নৌকার ছাউনিতে জোছনা বিলাস। যা পথের সব ক্লান্তি শেষ করে দেয়। বিশাল জলরাশিতে গানের তালে দুলাতে থাকে নৌকা। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মানুষ গেয়ে উঠে ‘এই চাঁদ খুঁজবে না উত্তর, একবার যদি বলো আমাকে, আমি থাকবো না নির্বাক…..আমি তারায় তারায়, রটিয়ে দেব তুমি আমার। ’ সেই গান কান পেতে শোনে পাশের মেঘালয়ের পাহাড়।