শেখ মাহতাব হোসেন :: খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে গাঁও গেরামের মহিলাদের ডাল তৈরী করার ঐতিহ্য জাঁতাকল। কালের পরিক্রমায় আর আধুনিক যন্ত্রপাতির আদলে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রা। সেই সাথে বিলিনের পথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী জাঁতা।
এক সময় উপজেলার প্রতিটি গ্রামের বাড়ীতে দেখা যেত এই জাঁতাকল। কিন্তু এখন গ্রামাঞ্চলের কোথাও জাতার ব্যবহার তেমন একটা চোখে পড়েনা। শোনাও যায়না ডাল ভাঙ্গার সেই কড় কড় শব্দ।
এক যুগ আগেও গ্রামাঞ্চালের মহিলাদের কাছে জাঁতা একটি প্রয়োজনীয় গৃহস্থলি উপকরণ ছিল। গ্রামের মধ্যে এক বাড়ীতে জাঁতা থাকলে আশপাশের বাড়ীর মহিলারা মসুরী, খেসারী, মটর কলাই ও মাশ কলাইসহ নানা ধরণের ডাল ভাঙানোর জন্য সকাল বিকেল লাইন দিয়ে বসে থাকতে হত। এমনকি বিয়ের পর নববধু উপহার হিসেবে বাবার বাড়ী হতে জাঁতা নিয়ে শুশুর বাড়ীতে আসত।
কিন্তু কালের বিবর্তে আধুনিক যন্ত্রপাতির কাছে হার মেনে সেই গৃহসামগ্রী জাঁতাকল এখন বিলুপ্তির পথে। খুবই মসৃণ দুই খন্ড পাথর গোল করে কেটে তৈরী করা হতো এই জাঁতাকল। সেই খন্ড দুটির ভিতরের ভাগ লোহার তৈরী যন্ত্র (বাটাল) দ্বারা ছোট্র ছোট্র গর্ত করে ধার করা হয় ডাল ভাঙানোর জন্য। এই দুটি পাটের (উপরের এবং নিচের অংশ) মাঝে একটি ছিদ্র করা হয়। আর সেই ছিদ্রের ভিতরে কাঁঠ বা বাঁশ দিয়ে হাতল তৈরী করে লাগানো হয়। যাতে দুইটি পাট আলাদা না হয় বা দুইটি পাটকে এক জায়গায় রাখতে সাহাষ্য করে। উপরের পাটের মাঝে আরো একটি ছিদ্র থাকে যা দিয়ে কলাই ভিতরে দেওয়া হয় পিষার জন্য এবং পাশে ক্ষুদ্র একটি ছিদ্র করা হয় যার মধ্যে কাঁঠের হাতল দিয়ে শুধু উপরের পাটকে ঘুরানো হয়। নিচের পাটের উপর ঘুরতে থাকে উপরের পাট। এই দুই পাটের ঘর্ষণের ফলে ভিতরে দেওয়া কলাই বেঙে ডাল তৈরী হয়ে জাঁতাকলের চারপাশ দিয়ে পড়তে থাকে।
এক যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলের মা-চাচি বা নববধুরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে এই জাঁতা কলের সাহাষ্যে কলাই থেকে ডাল বের করতে দেখা যেত। জাঁতাকল পাথরের তৈরী হওয়ায় চলাকালীন সময়ে মিষ্টি এক ধরণের কড় কড় শব্দ শোনা যেত। কিন্তু এখন আর ডুমুরিয়ায় দেখা যায় না এই জাঁতাকলের ব্যবহার। উন্নত প্রযুক্তি মেশিন তৈরীর ফলে সুখ প্রিয় বাঙালী পরিবার আর কষ্ট করে জাঁতা চালাতে চায় না।
বর্তমান এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সেই স্থান দখল করে নিয়েছে উন্নত প্রযুক্তির মেশিন। যে মেশিন বিদ্যুৎতে চলে। আর এ প্রযুক্তিতে অল্প সময়ে অনেক কাজ করা যায়। উন্নত এই প্রযুক্তির যুগে বিলুপ্তির পথে প্রায় পাথরের তৈরী সেই জাঁতাকল। তারপরও উপজেলার কিছু পরিবার এখনও এই জাঁতাকে গাঁও গেরামের ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছেন। তবে তার ব্যবহার খুব কম। শুধু মাত্র গ্রাম- বাংলার ঐতিহ্য হিসেবেই ধরে রেখেছেন অনেক পরিবার।
সরেজমিনে উপজেলা সদরের খলশী গ্রামে মোঃ ইলিয়াস হোসেনের বাড়ীতে গিয়ে চোখে পড়ে এমন দৃশ্য। দেখা যায় ঘরের বারান্দায় বসে এক গৃহবধূ জাঁতাকলে কলাই দিয়ে ডাল তৈরী করছেন। তারা জানান, এক সময় এই জাঁতা দিয়ে নানা প্রকার ডাল তৈরী করা হতো। এখন আর এ সবের ব্যবহার দেখা যায় না।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, আধুনিকয়তার ছোয়ায় আজ বিলুপ্তির পথে জাঁতা শিল্প। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে মানুষের মনেরও অনেক পরিবর্তন। মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করতে চায়। আবার পুষ্টির দিকে বিবেচনা করলে জাঁতায় ভাঙা দ্রব্য স্বাস্থ্যসম্মত।