১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করায় মূখ্য মন্ত্রী নূরুল আমিন সরকারের পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। সালাম, বরকত শহীদ হয়। তখনকার দিনে ফেসবুক, টুইটার, মোবাইল, চব্বিশ ঘন্টার চ্যানেল ও অনলাইন পত্রিকা ছিল না। টেলিফোন তাও হাতে গোনা কয়েকটি অফিস-আদালত ও বিত্তবানদের বাড়িতে। ঢাকায় ছাত্র শহীদ হওয়ার খবর পূর্ব পাকিস্তানের সতের জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ইথারে ইথারে পৌঁছে যায় দৌলতপুর মহসিন স্কুলের শিক্ষার্থীদের কানে।
ঢাকায় ছাত্র নিহত হয়েছে-সহমর্মিতা অনুভব করে তাৎক্ষণিক মহসিন স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে জঙ্গি মিছিলে নামে। দিন ও বারটি বায়ান্নো’র একুশে ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র মিছিলে গুলির খবরে থমকে যায় পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূ-খন্ড। চার কোটি বাঙ্গালী প্রতিবাদমূখর হয়ে পড়ে। সেই প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে মহসিন হাইস্কুলে। দুপুরে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অধ্যায়নরত ছিল। মৌলভী শিক্ষক আব্দুর রহমান নবম শ্রেণির ক্লাস বর্জন করে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের উদ্ধুব্ধ করেন। স্লোগান শুনে দশম শ্রেণির ছাত্ররা ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ে। প্রধান শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে সেদিন উৎসাহিত করেন। নেতিবাচক কর্মকান্ড পরিহার করার জন্যও তিনি পরামর্শ দেন। প্রধান শিক্ষক মহেশ্বরপাশার অধিবাসী ছিলেন। মহসিন হাইস্কুলের শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা আনুমানিক শতাধিক।
অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন গাজী শহীদুল্লাহ (পরবর্তীতে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও ’৭৩ সালে খুলনা পৌরসভার চেয়ারম্যান), এম বজলুর রহমান (পরবর্তীতে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ও আইনজীবী), আব্দুল লতিফ (পরবর্তীতে ব্যারিস্টার) এবং গাইকুড়ের অধিবাসী সরদার আতিয়ার রহমান। ছাত্রদের মিছিলটি বিএল কলেজের সামনের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে স্কুলে ফিরে আসে। তখনকার দিনে খুলনায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জিলা, মডেল, সেন্ট যোসেফস, বিকে, মহসিন, পল্লীমঙ্গল, করোনেশন, মহেশ্বরপাশা, সেনহাটি, নৈহাটী ও সাতক্ষীরার পিএন। ফেব্রুয়ারি মাসের কয়েকদিন মহসিন স্কুলের শিক্ষার্থীরা ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দৌলতপুর এলাকায় মিছিল-সমাবেশের আয়োজন করে। তাদের সেদিনের স্লোগান ছিল ‘মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের পদত্যাগ’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ও রাজবন্ধিদের মুক্তি চাই’।
ভাষা আন্দোলনে খুলনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তমুদ্দুন মজলিস ও নয়া সাংস্কৃতিক সংসদের। তমুদ্দুন মজলিসের খুলনার সভাপতি ছিলেন মরহুম এ্যাড. এসএম আমজাদ হোসেন (পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের শেষ দিককার শিক্ষা মন্ত্রী), সাধারণ সম্পাদক মরহুম এ্যাড. এম মোমিন উদ্দিন আহমেদ (তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ’৮৬ সালে জাপা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী)। মহসিন হাইস্কুলের সেদিনকার প্রেক্ষাপট স্মৃতির কোনে জমে থাকা আন্দোলনের বর্ণনাা করেন এড. এম বজলুর রহমান। বায়ান্নো সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে ১৯৫৬ সালে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৮১ ও ১০৯৫ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গর্বিত ভাষা সৈনিক।
তার দেওয়া তথ্য মতে, খুলনায় ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বর্গের মধ্যে মরহুম এম এ গফুর (১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য), এ্যাড. আব্দুল জব্বার (পরবর্তীতে জেলা ন্যাপের সভাপতি ও পৌরসভার চেয়ারম্যান), মরহুম এম এ বারী (১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য), অধ্যক্ষ মালিক আতাহার উদ্দিন (বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস), এ্যাড. শেখ আওছাফুর রহমান (গণতন্ত্রী পার্টি, পরবর্তীতে মুসলিম লীগ, ১৯৭৯ সালে সংসদ সদস্য), মরহুম আবু মুহাম্মদ ফেরদাউস (পরবর্তীতে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি), এম নূরুল ইসলাম (বিএনপি নেতা, ২০০১ সালে সংসদ সদস্য), আবুল কালাম শামসুদ্দিন শুনু মিয়া (পরবর্তীতে ন্যাপ নেতা), সদ্য প্রয়াত মাসিক সবুজপত্র সম্পাদক সমীর আহমেদ, মেধাবী ছাত্র লুৎফর রহমান জাহানগীর (পরবর্তীতে সাপ্তাহিক দেশের ডাক সম্পাদক)।
ভাষা আন্দোলনে ছাত্র শহীদ, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমাদের বৈষম্য এবং মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন সরকারের নির্যাতনের কারণে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় বলে ভাষা সংগ্রামী এ্যাড. এম বজলুর রহমান অভিমত দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনে মাধ্যমিক পর্যায়ে স্থানীয় সূতিকাগার মহসিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ১৮৭৬ সালে, জাতীয়করণ হয় ২০১৬ সালে।