চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ কুমির লালন-পালনে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বেধে দিয়ে একটি বিধিমালা জারি করেছে সরকার। ‘কুমির লালন-পালন বিধিমালা ২০১৯’ অনুযায়ী কুমিরের খামার স্থাপনে লাইসেন্স না নেয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের জন্য সর্বোচ্চ এক বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি পেতে হবে।
সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে বিধিমালাটি জারি করা হয়েছে।
কুমির সরীসৃপজাতীয় প্রাণী। বর্তমানে পৃথিবীতে কুমিরের তিনটি গোত্রে ২৫টি প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় এক ধরনের কুমির (ঘড়িয়াল) প্রচুর পাওয়া যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুমিরের বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। অষ্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে কুমির অপ্রচলিত খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ওই সব দেশে পর্যটন শিল্প হিসেবে কুমিরের খামার স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া কুমিরের চামড়া অনেক অভিজাত সামগ্রী তৈরিতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে বাংলাদেশে কুমিরের প্রজনন ও চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা। দেশে ময়মনসিংহ, বান্দরবানসহ বিভিন্ন স্থানে কুমিরের খামার গড়ে উঠেছে। তবে এ বিষয়ে কোনো বিধি-বিধান নেই।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকে কুমিরের খামার করছে। আইনি কাঠামোর মধ্যে এটি হওয়া উচিত। বিষয়টি রেগুলেট (নিয়ন্ত্রণ) করার জন্য আমরা বিধিমালাটি করেছি। আশা করি বিধিমালাটি খাতটির সুষ্ঠু বিকাশে সহায়ত হবে।’
লাইসেন্স, পজেশন সার্টিফিকেট, নবায়ন
বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো খামারি লাইসেন্স ছাড়া কুমির লালন-পালন, খামার স্থাপন বা আমদানি-রফতানি পরিচালনা করতে পারবেন না। বিধিমালা কার্যকর হওয়ার আগে কোনো ব্যক্তি কুমির লালন-পালন, খামার স্থাপন বা আমদানি-রফতানি পরিচালনা করে থাকলে তাকে বিধিমালা কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে লাইসেন্স নিতে হবে। লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ হবে প্রধান ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা।
সরেজমিন তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সন্তুষ্ট হলে কর্তৃপক্ষ এক বছরের জন্য লাইসেন্স দেবে। এক বছর পরপর লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।
লাইসেন্স পাওয়ার পর কোনো খামারি পজেশন সার্টিফিকেট (মালিকানা সনদ) ছাড়া কুমির নিজ মালিকানায় বা দখলে রাখতে পারবেন না।
কোনো খামারি আইন বা বিধান বা লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন করলে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে। লাইসেন্স বাতিল হলে সব কুমির ও কুমিরজাত পণ্য সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। লাইসেন্স বাতিল হলে পজেশন সনদও বাতিল হয়ে যাবে।
কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া খামার স্থাপন ও পরিচালনা, লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া খামার পরিচালনা, রেজিস্টার সংরক্ষণ বা তা পরিদর্শনকারী কোনো কর্মকর্তাকে প্রদর্শন না করলে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। এজন্য সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
লাইসেন্স ফি
বিধিমালায় বলা হয়েছে, কুমিরের খামার স্থাপনের জন্য সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার আওতাভুক্ত এলাকায় লাইসেন্স ফি এক লাখ টাকা ও প্রসেস ফি দুই হাজার টাকা। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার বাইরে সারাদেশে লাইসেন্স ফি ৫০ হাজার টাকা ও প্রসেস ফি দুই হাজার টাকা। প্রত্যেক কুমিরের জন্য বছরে পজেশন ফি দুই হাজার টাকা।
নবায়ন ফি লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আবেদনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ফি’র শতকরা ২৫ ভাগ, মেয়াদোত্তীর্ণের ৬০ দিনের মধ্যে আবেদনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ফি’র শতকরা ৫০ ভাগ এবং ৯০ দিনের মধ্যে আবেদনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ফি’র ৮০ ভাগ।
শাস্তি
লাইসেন্স না নেয়া, লাইসেন্স নবায়ন না করা ও পরিদর্শনকারী কর্মকর্তাকে তথ্য দিতে না পারলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে বিধিমালায়। একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
কুমির লালন-পালনের জন্য শর্তাবলী
বিধিমালা অনুযায়ী, কুমির লালন-পালনে একটি খামারের জন্য কমপক্ষে পাঁচ একর সম্পূর্ণভাবে বন্যামুক্ত জমি থাকবে যার দূরত্ব হবে সুন্দরবন থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার। ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ সুবিধা ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে। খামারের উদ্দেশ্যে কুমির আমদানি করা যাবে, তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সকল নিয়ম মেনে চলতে হবে।
কোনো অবস্থাতেই প্রকৃতি থেকে কুমির সংগ্রহ করা যাবে না। খামারিকে কেবল সাইটিস (কনভেনশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পেসিস অব ওয়াই্ল্ড ফাউনা অ্যান্ড ফ্লোরা) রেজিস্ট্রিকৃত খামার থেকে কুমির সংগ্রহ করতে হবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে কমপক্ষে ২০টি বংশ প্রদানকারী কুমির বা ১০০টি হ্যাচিং নিয়ে একটি খামার চালু করতে হবে, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে পরিচালিত হবে। খামারে কমপক্ষে দুজন কুমিরের খামার পরিচালনার ওপর প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ থাকবেন যারা প্রাণীবিদ্যা, অ্যানিম্যাল হাসবেন্ডারি, ফিশারিজ, কনজারভেশন বায়োলজি বা ওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা সমমানের ডিগ্রিধারী হবেন।
একজন পশু চিকিৎসক (ভ্যাটিরিনারি সার্জন) থাকবেন এবং কমপক্ষে দুজন খামার ব্যবস্থাপনার ওপর অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপক থাকবেন। যাদের বন্যপ্রাণী খামার ব্যবস্থাপনার ওপরও বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। খামারে স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর ঝুঁকিবিহীন নিরাপদ অবকাঠামোগত সুবিধাদি থাকতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
খামার এলাকায় কমপক্ষে দুই মিটার উচ্চতাসম্পন্ন নিরাপত্তার বেষ্টনী ও কুমির ছানার জন্য আলাদা বেষ্টনী থাকতে হবে। বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট, কুমিরের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা, কুমির ও কুমিরজাত পণ্যের যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য নিরাপদ সংরক্ষণাগার এবং কোয়ারেন্টাইন শেড, হ্যাচারি ও ইনকিউবেশন কক্ষ থাকতে হবে। প্রত্যেকটি খামার ঝুঁকিমুক্তভাবে পরিচালনার জন্য খামারে আন্তর্জাতিক মানসম্মত ও বন অধিদফতরের অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউরে (এসওপি) থাকবে এবং এর একটি প্রতিলিপি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় ওয়ার্ডেন অফিসে দাখিল করতে হবে।
খামারে প্রজননকৃত ও সংরক্ষিত কুমির সহজে শনাক্তকরণের জন্য আলাদা আলাদাভাবে ট্যাগিং করতে হবে। এ প্রক্রিয়ার জন্য প্রতিটি কুমিরের দেহে স্থানীয় বন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে বন বিভাগের সরবরাহ করা মাইক্রোচিপস স্থাপন করতে হবে।
সাইটিস রেজিস্ট্রিকৃত খামার থেকে কুমির বা কুমিরজাত পণ্য আমদানি বা রফতানি করতে হবে। খামারের কুমির রফতানিযোগ্য হওয়ার পর দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে কুমির বা কুমিরজাত পণ্য সংগ্রহের পর তা আলাদা আলাদাভাবে ট্যাগিং করে যথাযথভাবে সংরক্ষণাগারে সংরক্ষণ করতে হবে৷ খামারি সংরক্ষিত কুমির, কুমিরের মাংস বা কুমিরের চামড়া রফতানি বা কোনো রফতানিকারকের কাছে বিক্রি বা আমদানি করতে চাইলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সাইটিস-এর বিধিবিধান অনুসরণ করে মোট পরিমাণ উল্লেখ করে অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডেন বরাবরে আবেদন করবেন বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, প্রত্যেক খামারিতে কুমিরের সংখ্যা কম-বেশি ও আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো কুমির জন্মগ্রহণ করলে বা কোনো কুমির মারা গেলে ১০ দিনের মধ্যে ওয়ার্ডেন অফিসে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি সার্জনের ইস্যু করা জন্ম বা মৃত্যুর সনদসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।