চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃখুলনায় অবৈধভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত জমি দখল করে সেই জমির জমজমাট বেচাকেনা চলছে। আর এই জমিতে উঠেছে দু’ সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা। এসব অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন পাউবো কর্তৃপক্ষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধিগ্রহণকৃত জমি অবৈধভাবে দখল করে নগরীর বয়রা শশ্মান ঘাট সংলগ্ন আল-আকসা নগরের বাসিন্দা মো. মোশাররফ হোসেন দু’টি পাকা দোকান নির্মাণ করেছেন। নিজস্ব দ্বিতল ভবন লাগোয়া দোকান দু’টি ভাড়া দিয়ে বছরের পর বছর ধরে তিনি অর্থ উপার্জন করছেন।
শুধুমাত্র মোশাররফ হোসেন একা নন, এভাবে তার মতো পারুল আক্তার, মো. হারুন, হযরত আলী, ইয়াকুব আলী, ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদুল ইসলাম, মো. রফিক, পুলিশ সদস্য কামরুল ইসলামের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাসহ বেশ কয়েকজন প্রায় অর্ধশত অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। আবার অনেকেই সরকারি জমি সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (খুলনা পওর বিভাগ-১) আওতাধীন ১৫টি মৌজায় এবং ডুমুরিয়া উপজেলার বেড়িবাঁধের ওপর দু’সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমিখেকোরা সরকারি জমি দখল করে এসব স্থাপনা তৈরি করেছেন। কেউ কেউ অবৈধ স্থাপনায় বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, অনেকেই ভাড়াটিয়া অথবা নিজস্ব লোক উঠিয়ে দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করেছেন। তবে, এসব জমির অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক নির্লিপ্ততায় একাধিক ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে বিক্রি করা হয়েছে বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পাউবো, খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরের সূত্র জানান, ১৯৬২ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ নদী লাগোয়া লবণ পানি প্রবেশ রোধকল্পে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে। পরবর্তীতে এ জমির কিছু অংশ বাঁধে ব্যবহার হলেও দু’ পাশে বিশাল পরিমাণ জমি অব্যবহৃত অবস্থায় থেকে যায়। ওই অব্যবহৃত জমি বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই। এর মধ্যে শুধুমাত্র ডুমুরিয়ার চক আহসানখালী মৌজার ৬২২ নং দাগেই অধিগ্রহণকৃত জমির পরিমাণ ৩২ শতক। যার মধ্যে ২২ শতক জমিই ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে ইতোমধ্যেই ছয় জনের কাছে বিক্রি সম্পন্ন হয়ে গেছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া এ মৌজার ৩৪টি দাগে মোট ৩৭ দশমিক ১৬ একর জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে- মর্মে পাউবো’র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এ মৌজার ৬২৫ নং দাগে অবৈধ দখলদার পারুল আক্তার ওই জমিতে ৮-১০টি সেমিপাকা ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। একইভাবে মো. হারুন হোটেল নির্মাণ করে হুমায়ূন নামে এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দিয়েছেন, হযরত আলীর জমিতে ইট-খোয়া-বালুর ব্যবসা করছেন মোশাররফ হোসেন, ইয়াকুব আলী তার জমিটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দখলে রেখেছেন, ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদুল ইসলামও তার জমি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে বালু ভরাট করে রেখেছেন, মো. রফিক তার জমির একাংশে হোটেল করে নিজেই পরিচালনা করছেন এবং অপর অংশে ইজিবাইকের গ্যারেজ করে ভাড়া দিয়েছেন, পুলিশ সদস্য কামরুল ইসলাম তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমার জমিতে ইজিবাইক চার্জিং পয়েন্ট ও গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছেন, পাশে তার ভাগ্নে আকাশ আহমেদ ‘জামেলা এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। এর বাইরেও চকআহসানখালী মৌজার বিভিন্ন দাগে আরো শতাধিক অবৈধ স্থাপনা দৃশ্যমান রয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রথম দিকে বাঁধ লাগোয়া পার্শ্ববর্তী জমির মালিকানার সুযোগে এক শ্রেণির ভূমিখেকো প্রভাবশালী ব্যক্তি পাউবোর’র অধিগ্রহণকৃত জমিতে লোক বসিয়ে দখল প্রক্রিয়া শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সেখানে ছোট ছোট ঝুপড়ি ও ছাপড়া ঘর বা চা-পান-মুদি দোকান তুলে দখল পাকাপোক্ত করে। সর্বশেষ সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসকে ম্যানেজ করে নিজেদের নামে রেকর্ড করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়।
অবৈধ দখলদার মো. মোশাররফ হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি ২০০৬ সালে ১০ শতক জমি কিনে এখানে দোকানসহ দ্বিতল ভবন করে বসবাস করছেন। এর মধ্যে একাধিকবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভেয়ার মাপ জোক করেছে। কিন্তু কোন জমি বাধে নাই। তবে, দোকানের চালের কিছু অংশ সরকারি জমিতে পড়তে পারে বলে ধারণা তার।
আরেক দখলদার ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদুল ইসলাম জানান, তিনি ২০১৮ সালে এসএম কামরুল আলম মিন্টু নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ দশমিক ৩১ শতক জমি কিনেছেন। তার জমি অবৈধ সম্পত্তিভূক্ত নয়। তবে, উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন কেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
অপর দখলদার কানিজ ফাতেমার স্বামী পুলিশ সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, মাসুদ মোল্লা নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি ৫ শতক জমি কিনে বসবাস করছেন। অবমুক্তকরণসহ সকল কাগজপত্র দেখেই কিনেছেন। এখন শুনছেন এটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা। তাদের ভুল বুঝিয়ে এ জমি বিক্রি করা হয়েছে বলেও ধারণা করছেন তিনি।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (খুলনা পওর বিভাগ-১)’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘পাউবো’র অধিগ্রহণকৃত জমি দখল করে দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এমনকি অনেকেই অধিগ্রহণের তথ্য গোপন করে নিজ নামে রেকর্ড করিয়ে বিক্রিও করেছেন। ফলে সঠিক যাচাই না করে ওই জমি কিনে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। এর কোনটাই টিকবে না।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও পুনরায় দখল হয়ে গেছে। আবারো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বেহাত জমি উদ্ধার করা হবে।’