চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল সাব্বির নামে এক কিশোর। এই হত্যাকাণ্ডের পর নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। পাড়ায়-পাড়ায় সক্রিয় কিশোর অপরাধী গ্রুপের (কিশোর গ্যাং) তালিকা করা হয়েছিল। কিশোরদের আড্ডায় নিয়মিত হানা দিতেও শুরু করেছিল পুলিশ।
কিন্তু দেড় বছরের ব্যবধানে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের এই কার্যক্রম কার্যত থেমে গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ কিশোর অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রক এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ এসব চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এসব কিশোর এবং সদ্য কৈশোর পার করা তরুণরা রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতেও সক্রিয়।
ফলে চট্টগ্রাম নগরীর পাড়ায়-পাড়ায় আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। পুলিশের তথ্যমতে, নগরীতে অন্তত ১৫টি কিশোর গ্যাং আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীতে কিশোর অপরাধীদের সন্ধানে নেমেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। পাশাপাশি কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হচ্ছে পুলিশও।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম বলেন, ‘কিশোর অপরাধী এবং অপরাধপ্রবণ স্পটগুলোর তালিকা আমাদের কাছে আছে। সেই তালিকা ধরে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর যেসব স্পটে কিশোর-তরুণরা নিয়মিত আড্ডা দেয়, সেই স্পটগুলো আমাদের নজরদারিতে আছে।’
র্যাব-৭ এর সহকারি পরিচালক এএসপি মো.মাশকুর রহমান বলেন, ‘সদর দপ্তরের নির্দেশে আমরা কিশোর অপরাধী চক্রের তালিকা করতে শুরু করেছি। মূলত নগরীর যেসব স্পটে কিশোর-তরুণদের আনাগোণা বেশি থাকে এবং অপরাধ সংঘটিত হয়, সেসব স্পটকে আমরা আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করছি। নগরীর ১৬ থানা এবং জেলার ১৬ থানা এলাকা থেকেই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
সবশেষ বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) গভীর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় একটি কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্বের জেরে খুন হয়েছে এক তরুণ। পুলিশ জানিয়েছে, এই কিশোর গ্যাং চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। খুন হওয়া সদ্য কৈশোর পার করা তরুণসহ গ্যাংয়ের সব সদস্যই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এর আগে গত ৩০ জুন নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্বকলোনি এলাকায় সাপ পেটানোর মতো করে পিটিয়ে এক যুবলীগ কর্মীকে হত্যার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে কিশোর থেকে সদ্য কৈশোর পার করা তরুণ আছে।
গত ২৮ জুন রাতে ও পরদিন বিকেলে নগরীর লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল হাসনাত মো.বেলালের অনুসারীদের মধ্যে দু’দফা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে একজন গুলিবিদ্ধসহ ৪ জন গুরুতর আহত হন। এই ঘটনায় খুলশী থানায় তিনটি মামলা দায়ের হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষে জড়িতদের মধ্যে কিশোর এবং সদ্য কৈশোর পার করা তরুণরাও আছে।
গত দুই মাসে এই ধরনের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার পর চট্টগ্রাম নগরীতে ‘কিশোর গ্যাং কালচার’ আবারও আলোচনায় আসছে।
পুলিশ সূত্রমতে, ২০১৮ সালে আদনান ইসপার হত্যার পর নগর পুলিশ অপরাধ চক্রে জড়িত কিশোর এবং অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা করেছিল। তালিকায় প্রায় ৫৫০ জন কিশোরের নাম এসেছিল। অপরাধপ্রবণ স্পট, যেখানে নিয়মিত আড্ডা বসে, এই ধরনের স্পটের নাম এসেছিল প্রায় ৩০০। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন স্পটে আড্ডারত কিশোর-তরুণ দেখলে আটকের কথাও ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল নগর পুলিশের পক্ষ থেকে।
এসব কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্য নগরীর লালখানবাজার, চকবাজার, নন্দনকানন, সিআরবি, বিশ্বকলোনি, বহদ্দারহাট, পলিটেকনিক এলাকার কয়েকজন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতার নাম পেয়েছিল পুলিশ।
তালিকা তৈরির সঙ্গে জড়িত নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘তালিকাটি করা হয়েছিল ওসি লেভেলের উপরের কর্মকর্তাদের দিয়ে। মাঠপর্যায়ে ওসিদের কয়েকজনের মধ্যে সেই তালিকা নিয়ে কাজ করার কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ কিশোর-তরুণ অপরাধীদের যারা নিয়ন্ত্রক, তাদের প্রভাব অনেক বেশি। এর ফলে কিশোরদের অপরাধ দমনের বিষয়টি আর এগোয়নি।’
পুলিশ সূত্রমতে, কোচিংভিত্তিক, রাজনৈতিক, স্কুল-কলেজভিত্তিক, চাকরিজীবী- এই ধরনের অন্তত ১৫টি ক্যাটাগরির আড্ডার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। তালিকা তৈরির পর কয়েকমাস স্পটগুলো নিয়মিত পুলিশের নজরদারিতে ছিল। কিন্তু এখন সেই আড্ডাস্থলগুলো আবারও সরব কিশোর-তরুণদের আনাগোণায়। তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি, ফেসবুক-মোবাইল, প্রেম, চুরি-ছিনতাইসহ নানা বিষয়ে সামান্য মতানৈক্য থেকে কিশোর-তরুণরা জড়াচ্ছে প্রাণঘাতী সংঘাতে। গত দেড় বছরে কমপক্ষে ১০টি মামলা হয়েছে সরাসরি কিশোর অপরাধের জন্য। এছাড়া ছিনতাইয়ের অধিকাংশ মামলাতেই আসামির তালিকায় থাকছে কিশোর অপরাধীর নাম।
পুলিশ কর্মকর্তা আমেনা বেগম বলেন, ‘আমরা কিন্তু ঘটনা ঘটলেই অ্যাকশনে যাচ্ছি। এখন অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু পুলিশী অ্যাকশন দিয়ে তো এই ধরনের সামাজিক অপরাধ একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এছাড়া তাদের যারা নিয়ন্ত্রক, তাদেরও আমরা আইনের আওতায় আনার কাজ করছি।’