চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃখুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার সকল রুটে গতকাল সোমবার সকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে শ্রমিকরা। নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর বিভিন্ন ধারা সংশোধনের দাবিতে ও বাস্তবায়নের প্রতিবাদে স্বেচ্ছায় শ্রমিকরা কর্মরিবতিতে যাওয়ায় পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে কোন পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই হঠাৎ করে বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। পরিবহন শ্রমিক নেতাদের দাবি, আইন সংশোধনের পর এটি বাস্তবায়ন করা হোক। তা না করা পর্যন্ত আমাদের এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে পাশ হওয়া এ আইন গত পহেলা নভেম্বর প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। তবে আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই এর প্রবল বিরোধিতা করে আসছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো।
বাসচালকসহ মোটর শ্রমিক নেতারা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে নতুন আইনে চালকদের মৃত্যুদণ্ড এবং আহত হলে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। আমাদের এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তারা আরো জানান, একজন চালকের পক্ষে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। কারণ একজন চালকের বেতন সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এ কারণেই নতুন পরিবহন আইন সংশোধনের পর এটি বাস্তবায়নের জন্য তারা জোর দাবি জানান। তা না হলে তারা আর বাস চালাবেন না বলে জানান। অন্যদিকে আইনটি সম্পর্কে সবার স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণ দেখিয়ে আরো দুই সপ্তাহ পর তা কার্যকর করে সরকার।
শ্রমিকরা বলছেন, দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্যসহ সড়ক আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। তাদের দাবি, আইন সংশোধনের পরই এটি কার্যকর করা হোক। এটা না করা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি চলবে। তারা বলেন, সরকারের বিভিন্ন দফতরে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আইনটি সংশোধন ছাড়াই বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে ২১ ও ২২ নভেম্বর শ্রমিক ফেডারেশন বর্ধিত সভা ডেকেছে। ওই সভার এজেন্ডাগুলোর মধ্যে এক নম্বরে আছে সড়ক পরিবহন আইন সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এরপর থেকে বিভিন্ন জেলায় শ্রমিকরা ‘স্বেচ্ছায়’ এই কর্মবিরতি শুরু করে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য।
খুলনা : নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে খুলনা থেকে অভ্যন্তরীণ আন্তঃজেলা সকল রুটের বাস শ্রমিকরা সেচ্ছায় কর্মবিরতি পালন করছেন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘট রাত অবধি চলমান ছিলো। এদিকে পূর্ব নির্ধারিত বা কোন প্রকার ঘোষণা ছাড়াই শ্রমিকদের কর্মবিরতির ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। সকালে খুলনার সোনাডাঙ্গা আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে শত শত যাত্রী এসে ভিড় করেন। টার্মিনালে থাকা খুলনা থেকে অভ্যন্তরীন রুটের কোন বাস না ছাড়ায় বিপাকে পড়েছেন এসকল যাত্রীরা। জরুরি প্রয়োজনের কারনে অনেকে ইজিবাইক, মাহিন্দ্রা ভাড়া করে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। তবে সকালে খুলনা থেকে ঢাকার পরিবহন বন্ধ থাকলেও, দুপুরের আগেই চালু হয়। অপর দিকে খুলনা বিভাগীয় ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিকরাও কর্মবিরতি পালন করছেন। সোমবার সকাল থেকে খুলনার ট্রাক টার্মিনালসহ ট্রাকের বিভিন্ন লোডিং আনলোডিং পয়েন্টে ছিলো নিরবতা।
সরেজমিন খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, খুলনা থেকে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ রুটের বাস শ্রমিকরা কাজে যোগদান করেননি।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব বলেন, সড়কে অবৈধ নসিমন-করিমন চলে তাদের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। এসব যানবাহন বন্ধ ও চালকদের জরিমানা করা হয় না। বাস চালকদের ক্ষেত্রে জেল-জরিমানা হতে দেখা যায়। তিনি জানান, সোমবার সকালে শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে যাওয়ার পর যাত্রীদের কথা চিন্তা করে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। তবে যদি কোন চালক বাস চালাতে চায় তাকে যেন কেউ বাধা দিতে না পারে সে বিষয়ে নজর রাখা হয়েছে।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ নুরুল ইসলাম বেবী বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালাচ্ছেন না। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
সাতক্ষীরা : কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গতকাল সকাল থেকে সাতক্ষীরার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। হঠাৎ করেই বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়ে। তারা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে নছিমন, করিমন ও ইজিবাইক যোগে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌছানোর চেষ্টা করছেন। সব চেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন মহিলা ও শিশু যাত্রীরা। বেলা ১১টার দিকে সাতক্ষীরা শহরের নিউ মার্কেট মোড়, সঙ্গিতার মোড়, বাঙ্গালের মোড়, জজ কোর্টের সামনে, খুলনা রোড মোড়, নারিকেল তলা, কেন্দ্রী বাস টার্মিনাল, পৌর দিঘির পাড়, পুরাতন সাতক্ষীরা সেকেন্ড অফিসারের মোড়সহ বিভিন্ন বাস স্টপেজে যাত্রীদের বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা চান, আগে এটি সংশোধন করা হোক,এরপর এটি বাস্তবায়ন করা হোক। তিনি আরো জানান, শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিলে এতে মালিক পক্ষের কিছুই করার থাকেনা।
নড়াইল : সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর বিভিন্ন ধারা সংশোধনের দাবিতে গতকাল সোমবার সকাল থেকে জেলার অভ্যন্তরীণ রুটসহ নড়াইল-যশোর-খুলনা-মাগুরা সড়কে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ে যাত্রীরা। তাদের অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় ইজিবাইক, ভ্যানে করে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে।
নড়াইল বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহম্মেদ খান বলেন, আমরা এই আইন বাতিল চাইনা, সড়কে একটা সুষ্ঠু আইন থাকুক আমরাও চাই। আইনটা যে ভাবে তৈরি করা হয়েছে তার কতিপয় ধারার বিরুদ্ধে আমাদের আপত্তি। সকল মোটরযান ও চালকদের ওপর অধিক অর্থদণ্ড, জেল জরিমানার নতুন আইন সংশোধন করতে হবে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পুরোদমে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই কথা শুনে শ্রমিকরা বিশেষ করে ড্রাইভাররা প্রচন্ডভাবে আতঙ্কিত হয়ে গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছে।
বেনাপোল : বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় গতকাল সোমবার বেনাপোল বন্দর অভ্যন্তরে কোন মালামাল লোড ও আনলোড হয়নি। ফলে শত শত খালি ট্রাক পন্য লোড করার জন্য বন্দরের সামনে অবস্থান করে আছে। তবে দু’দেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যসহ পাসপোর্ট যাত্রী যাতায়াত স্বাভাবিক রয়েছে। তবে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি না হওয়ায় আজকের আমদানি পণ্য বন্দরে আনলোড করা সম্ভব হয়নি। নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে যশোর থেকে এই ধর্মঘট শুরু হয় গতকাল রবিবার। আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়।
বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থার শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা হোসেন জানান, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দশ জেলায় পরিবহন শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় বাস চালাচ্ছেন না। জেলাগুলো হলো, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা। পরিবহন সংস্থার শ্রমিক সমিতি যশোরের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশিদ জানান, ১৪ নভেম্বর যশোরে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে সড়ক আইন ২০১৮ সংশোধনের দাবি করা হয়। এরপর গত রবিবার সকাল থেকে যশোরের ১৮ রুটের শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু করে। তবে বেনাপোল-যশোর ও যশোর-সাতক্ষীরার অভ্যন্তরীণ রুটে কোনো যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করলেও কার, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, মাহেন্দ্রা, নসিমন-করিমন জাতীয় ছোট যানবাহন এবং অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
মোংলা : সড়ক পরিবহনের ঘোষিত আইন বাতিলের দাবিতে মোংলা বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ সকল রুটে পরিবহন ধর্মঘট চলছে। পরিবহন ধর্মঘটের কারনে সকাল থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। এদিকে হঠাৎ করে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার যাত্রী দুর্ভোগে পড়েন।
সকালে যশোরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া যাত্রী একলাছুর রহমান জানায়, যশোরে একটি জরুরি কাজের প্রয়োজনে সকালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নিয়েছিলাম কিন্ত মোংলা বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে চালক ও শ্রমিকরা। তবে সরকার যে আইন করেছে এ আইনের প্রতি আমরা সমর্থন জানাই। কারণ সড়ক মহাসড়কে বাস চালকরা কোন সড়ক আইন মেনে চলেনা। তারা তাদের ইচ্ছামত গাড়ি চলাচ্ছে।
খুলনা আন্তঃজেলা বাস-মিনিবাস, কোর্স ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা বাস চলাচল বন্ধ রাখিনি তবে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালাচ্ছে না। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি পালন শুরু করেছে।