চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃজ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন বৃদ্ধি, ট্যাংকলরি শ্রমিকদের ৫ লাখ টাকা দুর্ঘটনা বীমা চালু, ট্যাংকলরির ভাড়া বৃদ্ধিসহ ১৫ দফা দাবিতে খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে তেল উত্তোলন, বিক্রি ও পরিবহন বন্ধ রেখেছে পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। গতকাল রবিবার সকাল ৬টা থেকে ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ, পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতিসহ জ্বালানি ব্যবসায়ীরা এ কর্মবিরতি শুরু করেন। শ্রমিকরা পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল ডিপোর তেল উত্তোলন ও বিপণন বন্ধ রেখে এ কর্মসূচি পালন করছেন। খুলনাসহ ৩ বিভাগের তেল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। একই সাথে পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন যানবাহন চালকরা।
এদিকে জ্বালানী ব্যবসায়ীদের সাথে আজ সোমবার বিপিসি চেয়ারম্যানের সাথে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হবে কি না সে বিষয়ে জানা যাবে।
খুলনার বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প ঘুরে দেখা যায়, পাম্পের সামনে রশি টানিয়ে, ড্রাম ও প্লাস্টিকের খুঁটি দিয়ে প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন গাড়ি পাম্পে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। একই সাথে বন্ধ ক্যাশ কাউন্টার। বিক্রয়কর্মীরা বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। যানবাহন চালকরা তেল না পেয়ে ছুটছে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। চালকরা অভিযোগ করেছে বলেন, পাম্পগুলোতে তেল না পাওয়ায় ছুটতে হচ্ছে খুচরা তেল বিক্রেতাদের কাছে। তবে তারা লিটারে ১০/১২ টাকা অতিরিক্ত নিচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন চালকরা।
বাংলাদেশ তেল পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুরাদ হোসেন বলেন, কর্মবিরতি চলাকালে খুলনার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তেল ডিপো থেকে তেল উত্তোলন ও বিপণন বন্ধ রয়েছে। খুলনা বিভাগের ১০ জেলাসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলায় চলছে না ট্যাংকলরির চাকা। একই সঙ্গে পেট্রোল পাম্পে তেল বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-মহাসচিব ও খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরি ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ফরহাদ হোসেন বলেন, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে চলছে জ্বালানী তেল উত্তোলন, বিক্রয় ও পরিবহন বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও জানান, আজ সোমবার বেলা ১১টায় ঢাকায় বিপিসিতে জ্বালানী ব্যবসায়ীদের সাথে বিপিসি চেয়ারম্যানের বৈঠক রয়েছে। বৈঠকের পর পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে।
১৫ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে-জ্বালানি তেল বিক্রির প্রচলিত কমিশন কমপক্ষে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রদান, জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীরা কমিশন এজেন্ট নাকি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিষয়টি সুনির্দিষ্টকরণ, প্রিমিয়াম পরিশোধ সাপেক্ষে ট্যাংক-লরি শ্রমিকদের ৫ লাখ টাকা দুর্ঘটনা বীমা প্রদান, ট্যাংক-লরির ভাড়া বৃদ্ধি, পেট্রোল পাম্পের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের লাইসেন্স গ্রহণ বাতিল, পেট্রোল পাম্পের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের লাইসেন্স গ্রহণ বাতিল, পেট্রোল পাম্পে অতিরিক্ত পাবলিক টয়লেট এবং জেনারেল স্টোর ও ক্লিনার নিয়োগের বিধান বাতিল, সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক পেট্রোল পাম্পের প্রবেশদ্বারের ভূমির জন্য ইজারা গ্রহণের প্রথা বাতিল, ট্রেড লাইসেন্স ও বিস্ফোরক লাইসেন্স ব্যতিত অন্য দফতর বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক লাইসেন্স গ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল, বিএসটিআই কর্তৃক আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাংক ৫ বছর অন্তর বাধ্যতামূলক ক্যালিব্রেশনের সিদ্ধান্ত বাতিল, ট্যাংক-লরি চলাচলে পুলিশী হয়রানি বন্ধ, সুনির্দিষ্ট দফতর ছাড়া সরকারি অন্যান্য দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ডিলার বা এজেন্টদেরকে হয়রানি বন্ধ, নতুন কোনও পেট্রোল পাম্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় জ্বালানি তেল মালিক সমিতির ছাড়পত্রের বিধান চালু, পেট্রোল পাম্পের পাশে যেকোনও স্থাপনা নির্মাণের আগে জেলা প্রশাসকের অনাপত্তি সনদপত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, মোংলা, নড়াইল বেনাপোলসহ বিভিন্ন জেলায় ট্যাংকলরী থেকে জোরপূর্বক পৌরসভার চাঁদা গ্রহণ বন্ধ করতে হবে।
যশোর, বাগেরহাট ও ঝিনাইদহ জেলা থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন এই কর্মবিরতির খবর। সকাল থেকে পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেল বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। আর এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা।
আমাদের যশোর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ১৫ দফা দাবিতে ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিক ও জ্বালানী তেল ব্যবসায়ীদের ডাকা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে যশোরে ৭৪টি পাম্প। গতকাল রবিবার ভোর থেকেই পাম্পগুলোতে তেল আনতে যাওয়া গাড়ির চালকদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এদিকে ধর্মঘটের নামে জনভোগান্তি তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ মানুষ। আর গাড়ি চালকরা দাবি করেছেন এ অবস্থা চলতে থাকলে কাল থেকে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
জ¦ালানি তেল পরিবেশক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাজ্জাদুল করিম কাবুল জানান, জ্বালানী তেল ব্যবসার সাথে জড়িত সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে তেল বিক্রিতে কমিশন বৃদ্ধিসহ ১৫ দফা দাবি জানিয়ে আসছিল। সরকার এসব দাবি বাস্তবায়নের আশ^াস দিলেও তা কার্যকর করেনি। দাবি আদায়ের জন্য ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আল্টিমেটামও দেয়া হয়েছিল। দাবি বাস্তবায়নে কার্যকরি আশ^াস পেলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে, ধর্মঘটের কারণে যশোরের ৭৪টি পেট্রোল পাম্প থেকে সকল ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভোর থেকেই পাম্পগুলোতে তেল আনতে গেলে গাড়ির চালকদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। গাড়ি চালকরা জানিয়েছেন, তেল না পেলে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। তাই দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি।
আমাদের বাগেরহাট প্রতিনিধি, খুলনা বিভাগের সকল জেলাগুলোর মত বাগেরহাটেরও পেট্রোল পাম্পগুলো তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। আর এ সুযোগে কিছু অসাধু খুচরা পেট্রোল ও ডিজেল ব্যবসায়ীরা লিটারে ১০/১৪ টাকা বাড়িয়ে পেট্রোল ও ডিজেল বিক্রি করছেন। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন মোটরসাইকেল ও যাত্রীবাহি বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকরা।
গতকাল রবিবার শহরের বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি পাম্পের সামনে মোটা-রশি ও তেলের ড্রাম দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে কোনো যানবাহন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পাম্প গুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকলেও তারা তেল বিক্রি করছে না। বাগেরহাট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় বসে থাকা ট্রাক চালক কামাল শেখ বলেন, আজ যে পাম্পগুলো বন্ধ থাকবে, আমার তা জানা ছিলো না। ট্রামে নিয়ে পাম্পে গিয়ে দেখি তেল বিক্রি বন্ধ। “তাই কাজ-কাম বন্ধ দিয়ে বসে আছি”। ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক হিরণ মোল্লা বলেন, মোটরসাইকেলে যাত্রী উঠিয়ে পাম্পে এসে দেখি তেল বিক্রি বন্ধ। বাধ্য হয়ে যাত্রী নামিয়ে ফিরে এসেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খুচরা তেল বিক্রেতা জানান, পাম্পগুলোতে তেল বিক্রি বন্ধ থাকার কারনে খুচরা দোকানগুলোতে মোটরসাইকেল, যাত্রীবাহী মাহেন্দ্রা, বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকরা ভিড় করছে। এ সুযোগে খুচরা তেল বিক্রেতারা পেট্রোল প্রতি লিটারে ১৪ টাকা ও ডিজেলে ১০ টাকা বেশি নিচ্ছে। এরপরও জেলার অধিকাংশ খুচরা তেলের দোকানগুলোতে তেল পাচ্ছে না যানচালকরা।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ১৫ দফা দাবিতে ঝিনাইদহে পেট্রোল পাম্পগুলোতে চলছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। সকাল থেকে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করছে পাম্পগুলোর মালিক ও শ্রমিকরা। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে মোটরসাইকেল, বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের মালিক শ্রমিকরা। জ্বালানি তেল না পেয়ে অনেককে পাম্প থেকে ফিরে যেতে দেখা গেছে। অনেকে শহর থেকে দূরের উপজেলায় যেতে পারছেন না। তেলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছু বাস-ট্রাক।
মোটরসাইকেল চালক সাদ্দাম হোসেন বলেন, শহর থেকে কালীগঞ্জ যাওয়ার জন্য তেল নিতে পেট্রোল পাম্পে আসেন। কিন্তু এসে দেখতে পান তেল বিক্রি বন্ধ। এখন বাসায় ফিরে যেতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ এলাকায় জেভি ফিলিং স্টেশনের মালিক নায়েব আলি জোয়ার্দ্দার জানান, তারা ১৫ দফা দাবিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেছেন। সকল পেট্রোল পাম্প থেকে সকল প্রকার জ্বালানী তেল বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে।
আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধের প্রথম দিনেই দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে সাতক্ষীরায়। ধর্মঘটের কারণে গতকাল রবিবার সকাল থেকে সাতক্ষীরার কোনো পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি তেল বিক্রি করা হচ্ছেনা। এর ফলে জ্বালানি তেল না পেয়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকরা পড়েছেন বিপাকে। যারা ধর্মঘটের খবরে আগাম জ্বালানি তেল সংগ্রহ করেছিলেন তারাই কেবল মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহন চালাতে পারছেন।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ভাই ভাই ফিলিং স্টেশনের স্বত্বাধিকারি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভোর ৬টা থেকে তারা ধর্মঘট পালন করছেন। এ কারণে সকাল থেকেই ফিলিং স্টেশন থেকে আর কাউকে জ্বালানি তেল দেওয়া হচ্ছে না। তাদের ১৫ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আরো জানান।
পেট্রোল পাম্পে তেল নিতে আসা ত্রেতা মাহবুবুর রহমান জানান, ধর্মঘটের খবরটা ভাল ভাবে প্রচার করা হয়নি। ফলে হঠাৎ করেই চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। এমন অবস্থায় খোলা বাজারেও পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল মিলছে না। এর ফলে জ্বালানি তেল না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন তার মত অনেকেই।
এদিকে, হঠাৎ করেই জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট যানবাহন মালিকরাও পড়েছেন দুর্ভোগে। জ্বালানি তেল না পেয়ে সাতক্ষীরার অনেকেই যানবাহন চালাতে পারছেন না।