কাজী মোতাহার রহমান
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক সমাজের অবদান আপন বৈশিষ্টে উজ্জল। ভাষা সংগ্রামে গোটা ইতিহাসের উপর দৃষ্টিপাত করতে গেলে প্রথমেই যে অধ্যায়টির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটবে, সেটি নিঃসন্দেহে সংবাদপত্রের অগ্রণী ভূমিকার চিত্রই তুলে ধরবে স্পষ্ট রেখায়। গণমাধ্যম হিসেবে আমরা এখানে সংবাদপত্রকে একেবারেই শুরুতে বিবেকের প্রহরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখতে পাই। যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংবাদপত্রের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার ব্যতিক্রম ছিল না।
১৯৪৮ থেকে ৫২ পর্যন্ত খুলনায় কোন দৈনিক পত্রিকা ছিল না। ছিল সাপ্তাহিক, মাসিক ও পাক্ষিক। অফসেটে পত্রিকা ছাপার কোন সুযোগ ছিল না। ছাপা হতো লেটার প্রেসে। সীসের তৈরি টাইপ দিয়ে অক্ষর সাজানো হতো। সদ্য দিনের ছবি ছাপার কোন প্রযুক্তি ছিল না। জিঙ্ক দিয়ে জমাট করে ব্লক তৈরি করা হতো। তার পিছনে থাকতো এক ইঞ্চি উঁচু কাঠ। এভাবেই ছবি ছাপা হতো। পেশাদার ফটো সাংবাদিক ছিল না। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির নানা কালা কানুন উপেক্ষা করে সাংবাদিকতা করতে হয়েছে আমাদের পূর্বসুরীদের। ৪৮ থেকে ৫২ পর্যন্ত খুলনার সাহসী সংবাদিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন, দৌলতপুরের শরীফ আমজাদ হোসেন, সাপ্তাহিক প্রবাহ সম্পাদক খন্দকার আব্দুল হাফিজ, সাতক্ষীরার আব্দুল ওহাব সিদ্দীকী, সমীর আহম্মেদ, বাগেরহাটের আব্দুল বারী ইজারাদার, মনিরুল হুদা, বাগেরহাটের মাজহারুল ইসলাম বাবু মিয়া ও আমজাদ হোসেন গোরাই মিয়া।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় আটচল্লিশ সালে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাড়ে চার কোটি বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ ‘উর্দু নয়, রাষ্ট্রভাষা বাংল চাই’। কুমিল্লার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। তিনি কংগ্রেসের আদর্শ ও দর্শণে বিশ্বাসী। সচেতন মহল এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার ঢেউ এসে পৌঁছায় খুলনার দৌলতপুর বিএল একাডেমিতে।
সে সময়কার ছাত্রলীগ নেতা, ভাষা সৈনিক তাহমীদ উদ্দীনের লেখা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। আটচল্লিশ সালে দৈনিক আজাদে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯ ফেব্রুয়ারি খুলনা, দিনাজপুর, পাবনা ও মুন্সীগঞ্জে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। খুলনার দৌলতপুরে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। আটচল্লিশ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে বি এল একাডেমী ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় (স ম বাবর আলী রচিত মহান একুশে স্মরণিকা-২০১৫)। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ আটচল্লিশ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জেলায় হরতাল আহ্বান করে (সিরাজ উদদীন আহমেদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। কর্মসূচি সফল করতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান খুলনায় আসেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেখ মুজিবুর রহমান)। তাঁর আগমন উপলক্ষে দৌলতপুর বিএল একাডেমিতে ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়। মুসলিম লীগ সমর্থকরা মারপিট করলেও তিনি ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেন।
দৈনিক আজাদ ও সংবাদে মাঝে মধ্যে খুলনার ভাষা আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশিত হত। ১৯৪৮-৫২ পর্যন্ত ভাষা সংশ্লিষ্ট যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে সে ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে স্থানীয় মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো।
তওহীদ : দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালের ৮ জুন তওহীদ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা খুলনা থেকে প্রকাশিত হয়। শহরের থানার মোড়ে মুসলিম আর্ট প্রেস থেকে পত্রিকাটি মুদ্রিত হত। শামসুর রহমান ছিলেন পত্রিকার প্রথম দিকের সম্পাদক। প্রকাশক ছিলেন সরদার আনসার আলী। দক্ষিণাঞ্চলের ধন্যাঢ্য ব্যক্তি এলেম বক্স পত্রিকা প্রকাশনায় অর্থ যোগান দিতেন। পত্রিকার সম্পাদক ১৯৫৯ সালের দিকে খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পত্রিকা প্রকাশনার সময় তিনি কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন। সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের নানাবিধ রিপোর্টের কারণে সম্পাদনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব আবদুল ওহাব সিদ্দিকের ওপর অর্পিত হয়।
আবদুল ওহাব সিদ্দিকীর সাংবাদিকতার জীবন শুরু ব্রিটিশ জামানায় কলকাতা থেকে। আট পৃষ্ঠার ডিমাই সাইজের তওহীদ নামক সাপ্তাহিকটির মূল্য ছিল দুই আনা, বার্ষিক আট টাকা। প্রতি শুক্রবার এটি প্রকাশিত হত। তওহীদ সাহিত্য পত্রিকা হলেও স্থানীয় সমস্যা ভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হত। রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনও গুরুত্ব সহকারে স্থান দেয়া হত। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চলাকালে তওহীদ বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পত্রিকাটি মুসলিম লীগের কর্মকান্ডকে বিরোধিতা করত। ভাষা আন্দোলন ভারতীয় এবং কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত বলে এই পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রকাশ হত। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বাঙালি কৃষ্টি ও লোকাচার সব কিছুতেই হিন্দুয়ানী আখ্যায়িত করে সাপ্তাহিক তওহীদের প্রতিবেদন প্রকাশ অব্যাহত থাকত। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধিতা করাই ছিল এ পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য। পত্রিকাটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৫৩ সালে সম্পাদক আবদুল ওহাব সিদ্দিকী তওহীদ পত্রিকা ছেড়ে পাক পয়গাম নামক পত্রিকায় যোগদান করেন। শামসুর রহমান কৃষি বিভাগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই সময়ে তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। আমৃত্যু এই দলের সাথে ছিলেন। তিনি আলতাপোল লেনে বসবাস করতেন। পত্রিকাটিতে জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকান্ডের খবরা খবর ফলাও করে প্রচার করা হত। তওহীদ জামায়াতের স্থানীয় মুখপাত্র হয়ে ওঠে (ডঃ শেখ গাউছ মিয়া রচিত মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে)। ১৯৫৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক তওহীদ পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয় প্রথম পাতায়। সম্পাদকীয়’র শিরোনাম ছিল ‘বিকারগ্রস্থ সোহরাওয়ার্দী’। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, আর এই অবসর সময়ে তিনি যেন ইসলামী শাসন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের অন্ততঃ চেষ্টা করেন। অন্যথায় পরিষদের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করার ভূতের শ্রাদ্ধ হইতে বিরত থাকুন জাতি এই আশাই আপনার কাছে করিতেছে। এই পত্রিকার মাধ্যমেই শহরে নতুন কবি ও সাহিত্যিক সৃষ্টি হয়। সাহিত্য ভিত্তিক পত্রিকাটি স্বল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৮৮ সালের পর এ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়নি।
প্রবাহ : মুসলিম লীগের আশীর্বাদ নিয়ে ১৯৫০ সালে প্রবাহ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। খোন্দকার আব্দুল হাফিজ এ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। তিনি ১৯৪৮-১৯৫২ খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০-১৯৫২ বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। ১৯৫২-১৯৫৫ ইত্তেফাকের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭০ সালে নড়াইল থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্থানীয় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা আব্দুস সবুর খান ও এস এম এ মজিদ পত্রিকা প্রকাশে অর্থ যোগান দিতেন। এতে মুসলিম লীগের নীতি আদর্শের প্রতিফলন ঘটতো। সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও জেলার বিভিন্ন থানার সংবাদ প্রকাশিত হত। বিশেষ করে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড, প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বক্তৃতা বিবৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হত। বিএল কলেজের ছাত্র আন্দোলনের খবর প্রবাহের পাতায় ছাপা হত না। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হত। এ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হত ‘তথাকথিত ভাষা আন্দোলন’ ভারতের সৃষ্টি। কমিউনিস্টরা এ আন্দোলন পরিচালনা করছে। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত করছে। কমিউনিস্টরা ঈমান আকিদার ওপর আঘাত হানছে। ভারতের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে কলাম লেখা হত। খোন্দকার আব্দুল হাফিজ ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে আন্দোলনে সক্রিয় হলে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে প্রবাহ প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
তকবীর : ১৯৫০ সালের আগষ্ট মাসে তকবীর নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। খুলনার সাংবাদিকতার পথিকৃত দৌলতপুরের শরীফ আমজাদ হোসেন পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। ম্যাগাজিন সাইজের এ পত্রিকা প্রথমে ফেরীঘাট মোড়স্থ মুসলিম স্কলার প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে পরে আইডিয়াল প্রেস থেকে ছাপা হত।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে মাসিক তকবীরের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। দক্ষিণ জনপদের সংকট সমস্যা, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ বিশেষ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে মাসিক তকবীরের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ছাত্র ফেডারেশনের নেতা সরদার আনোয়ার হোসেন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে ছাত্রসমাজ যে প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে তার ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন ছিল মাসিক তকবীরের পাতায়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিলেও পরে তার বিবৃতি প্রত্যাহার করেন। খুলনা মুসলিম লীগ অধ্যুষিত এলাকা হলেও ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে খান এ সবুরের অবস্থান নেওয়াকে মাসিক তকবীর নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। সম্পাদক শরীফ আমজাদ হোসেন স্পষ্টবাদী। এ কারণে তার সুনাম ছিল। সম্পাদকীয় লেখা হত ঈদ উৎসব, বিদ্যুৎ সমস্যা, ভৈরব নদের ভাঙন, দক্ষিণাঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ভাঙন এবং ভাষার দাবি নিয়ে। এ পত্রিকার জনপ্রিয় কলাম ছিল, ‘নীল চশমার ফাঁকে’, সম্পাদক নিজেই এ কলামটি লিখতেন। পত্রিকার লেখনীতে মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের সমালোচনা থাকতো। খুলনায় ভাষা আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মাসিক তকবীরের ভূমিকা ছিল সহায়ক।
সবুজপত্র : ১৯৫১ সালে নীলা সিনেমা হলের বিপরীতে (আজকের পিকচার প্যালেস) স্টুডিও ফোকাসের দোতলা থেকে মাসিক সবুজপত্র নামে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সমীর আহমেদ এই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জড়িত। আর্থিক সাশ্রয়ের জন্য বাগেরহাটের প্রেস থেকে সবুজপত্র ছাপা হত। প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল আট আনা। ম্যাগাজিন সাইজের পত্রিকাটি এ অঞ্চলের কৃষক আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হত। ১৯৫০ সালে গঠিত নয়া সাংস্কৃতিক সংসদ এবং ১৯৫২ সালে স্থানীয়ভাবে গঠিত ভাষা সংগ্রাম পরিষদের তিনি সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সবুজপত্রে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপমূলক লেখা ছাপা হত। ভাষার দাবিতে কবিতা ও প্রবন্ধকে প্রাধান্য দেয়া হত। প্রবন্ধ লিখতেন মরহুম অধ্যক্ষ মালিক আতাহার উদ্দীন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী রূপসার বেলফুলিয়ায় বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষার দাবিতে সম্পাদকীয় এবং প্রতিবেদন ছাপা হওয়ায় পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্পাদকের জবানবন্দী অনুযায়ী সার্কুলেশন ছিল পাঁচ’শ কপি। ১৯৫২ একুশে ফেব্রুয়ারির পর মুসলিম লীগের লাঠিয়ালরা সবুজপত্র অফিসে হামলা চালায়। পত্রিকার লেটার প্রেসের সরঞ্জাম ক্ষতিসাধন করে। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে সরকার সবুজপত্র প্রকাশনার অনুমতি বাতিল করে। সবুজপত্র সম্পাদক, ভাষা সৈনিক সমীর আহমেদ ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন।
আল হাদী : ১৯৫১ সালে বাগেরহাট থেকে আল হাদী নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আব্দুল বারী ইজারাদার এর সম্পাদক ছিলেন। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদ, নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় ছেপে জনমত সৃষ্টিতে আল হাদী সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাগেরহাট স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম বাবু মিয়া এ পত্রিকায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত প্রবন্ধ লিখতেন। আল হাদী নামক পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় পাঠক প্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে সাপ্তাহিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেঃ মোঃ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত আল হাদীর অস্তিত্ব ছিল। সম্পাদক আব্দুল বারী ইজারাদারের সম্পাদনায় ১৯৯১ সালে বাগেরহাট থেকে উত্তাল নামে দৈনিক কাগজ প্রকাশিত হয়। এখন তার প্রকাশনা বন্ধ।
বিদ্যুৎ : ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে বাগেরহাট রেল রোড থেকে বিদ্যুৎ নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। মনিরুল হুদা ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। তিনি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। এখন আয়কর আইনজীবী। বাংলাদেশ আয়কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি। এক সময় খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে দৈনিক বাংলার প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাসিক বিদ্যুৎ পত্রিকাটি স্থানীয় ফাইন আট প্রেস থেকে ছাপা হত। ডিমাই সাইজের এ পত্রিকার মূল্য ছিল আট আনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বোধকে সমুন্নত রাখতে মাসিক বিদ্যুৎ স্বোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করে। পত্রিকা প্রকাশের পাঁচ মাস পর তা বন্ধ হয়ে যায়। সম্পাদক উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বাগেরহাট ত্যাগ করলে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
(তথ্য সূত্র: ড. শেখ গাউস মিয়া রচিত মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে, আব্দুল্লাহ হোসেন বাচ্চু রচিত খুলনার ভাষা আন্দোলন, এ্যাড. আব্দুল হালিম রচিত পুরাঘটিত বর্তমান ও স ম বাবর আলী সম্পাদনায় একুশের স্মরণিকা-২০১২)
লেখক: সংবাদ কর্মী, খুলনা।