‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’- আবহমানকাল থেকে চলে আসা এ প্রবাদটিতে যুগের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্ত হয়েছে বহুমাত্রিকতা। তাই তথ্যপ্রযুক্তির এ বৈপল্গবিক যুগে শুধু শিক্ষাই নয়; বরং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে- মানসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, নৈতিকতা-সমৃদ্ধ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে একটি আদর্শ জাতি গড়ে তোলা। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের চার নম্বর অভীষ্টে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই শিক্ষার মানোন্নয়নে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারই যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমান সময়ে যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। খুলনা জেলা প্রশাসন, সরকারের সব গৃহীত পদক্ষেপ যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারকি করার পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নে যুগোপযোগী বিভিন্ন ইনোভেটিভ উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে ‘চাইল্ড ইনটিগ্রিটি ও শিশু বঙ্গবন্ধু ফোরাম’ স্থাপন খুলনা জেলা প্রশাসনের অন্যতম কার্যকর ও আশাব্যঞ্জক দীর্ঘমেয়াদি ইনোভেটিভ উদ্যোগ।
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনায় বোঝা যায়, মানুষের নৈতিক ও মূল্যবোধগত যথেষ্ট অধঃপতন ঘটেছে। মেধাবী বুয়েটিয়ান কর্তৃক আবরার হত্যা, ব্যাপকহারে শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, কিশোর গ্যাংয়ের আবির্ভাবের মতো ঘটনাগুলোর মাধ্যমে সমাজের সার্বিক অবনমনই প্রতিভাত হয়। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক বা ক্যাসিনোর প্রাচুর্যের ঘটনাবলিও মানুষের অত্যধিক নৈতিক অবক্ষয় প্রকাশ করে। এসব ঘটনার মূলে রয়েছে শৈশব থেকে শিশুদের মধ্যে যথার্থ নৈতিকচর্চার অভাব। এ জন্য শৈশব থেকেই শিশুদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে।
নৈতিকতা চর্চার গুরুত্ব অনুধাবন করে জাপানের স্কুলগুলোতে বহু আগে থেকেই সপ্তাহে কমপক্ষে একটি ঘণ্টা নৈতিকতা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখা হয় এবং ২০১৮ থেকে প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুলগুলোতে নৈতিক শিক্ষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে ক্যারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধকরণে যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশবিষয়ক শিক্ষার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
এসব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি বিদ্যালয়ে এবং প্রতিটি মহাবিদ্যালয়ে খুলনার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ চাইল্ড ইনটিগ্রিটি ও শিশু বঙ্গবন্ধু ফোরাম প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে; যেন শৈশব থেকেই শিশুর মধ্যে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ, পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয় এবং পরিণত বয়সে যেন তারা প্রকৃত ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। যেহেতু আজকের শিশুরাই আগামী দিনের সোনার বাংলার রূপকার; তাই যথাযথ পরিচর্চার মাধ্যমে গড়ে ওঠা নতুন এ প্রজন্মের হাত ধরেই আসবে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলার সোনালি প্রভাত।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ত্রিমাত্রিক উদ্দেশ্যে এ ফোরাম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সব শিশুকে একটি নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চা এবং নৈতিক গুণাবলির সমন্বয় করা; সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানার্জনের প্রতি শিশুদের আগ্রহী করা। নীতি-নৈতিকতা, সততা ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা করা।
ফোরাম যেসব কাজ করবে, তার মধ্যে রয়েছে- শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা শিক্ষার প্রসার করা এবং শৈশব থেকেই নীতিবান, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে তাদের যথার্থ শিক্ষাদান। সামাজিক ও জাতীয় মূল্যবোধের চেতনার বীজ শিশুদের মনে বপন করা এবং কৈশোরে যেন তা উপযুক্তভাবে পরিস্ম্ফুটিত হয়, সে জন্য পরিকল্পিত শিক্ষাদান। শিশুদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা লালন করা এবং পরিণত বয়সে যেন তারা তা ধারণ করতে পারে, সে জন্য সাপ্তাহিক আলোচনা ও পাঠচক্র পরিচালনা। শিশুদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সহজীকরণ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর বিস্তারিত ধারণা প্রদান। পরিচ্ছন্ন গ্রাম, পরিচ্ছন্ন শহর-কর্মসূচি সম্পর্কে ধারণা প্রদান এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখার মানসিকতা তৈরি করা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করা। উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ুগত প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞানদান ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে ধারণা প্রদান। খুলনা জেলার অবস্থান উপকূলীয় অঞ্চলে হওয়ায় শিশুদের উপকূলীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে পাঠদান এবং দুর্যোগের প্রস্তুতিমূলক কর্মশালা আয়োজন। খুলনা জেলার অনেকাংশজুড়েই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে অবস্থান হওয়ায় ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে শিশুদের মধ্যে আলোচনা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, টেলিফিল্ম এবং সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করা। শিশু অধিকার সনদ এবং সংবিধানের আলোকে নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করা। বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও বিজ্ঞান মেলার আয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন গোলগুলোর ধারণা শিশুদের মাঝে সহজীকরণের জন্য ব্যবহারিক ও তথ্যমূলক পাঠ এবং ডকুমেন্টারি প্রদর্শন। গ্রহণযোগ্য ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে একটি বন্ধুসুলভ পল্গ্যাটফর্ম তৈরি করা। প্রতিবন্ধী ও জাতিগত সংখ্যালঘু শিশুদের অন্তর্ভুক্তকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ। পরিবেশ দূষণ (বিশেষ করে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ) সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করে তোলা এবং সে অনুযায়ী দূষণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের শিক্ষাদান। শিশুদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গঠনে শিক্ষাদান। শিশুদের ্রট্রাফিক আইন ও রোড সিগন্যাল সম্পর্কে সচেতন করা এবং নিরাপদ সড়ক আইন সম্পর্কে ধারণা প্রদান।
একটি আদর্শ জাতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুশিক্ষার বিকল্প নেই। আর সুশিক্ষার আদর্শগত উৎকর্ষের নিমিত্তে প্রয়োজন সততা, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিষ্ঠার আলোয় শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে আলোকিত করা। এ লক্ষ্যেই ‘চাইল্ড ইনটিগ্রিটি ও শিশু বঙ্গবন্ধু ফোরাম’-এর অভিযাত্রা।
মোহাম্মদ হেলাল হোসেন
জেলা প্রশাসক, খুলনা