সবুজ মিয়া,ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ লুৎফর রহমান, আব্দুল কাদের, আব্দুল মান্নান, নুরুল হুদা, কাশেম ফকির নামের মানুষগুলোর অস্তিত্ব মেলেনি পার শ্রীরামপুর গ্রামে। এমন ৯০ জনের নাম রয়েছে যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি গ্রামটিতে। গ্রামবাসী বলছেন এই নামগুলোর মানুষ তাদের গ্রামের নেই। ২/৪ জনের নাম মিললেও বাবার নামে মিল নেই। অথচ অস্তিত্বহীন এই মানুষগুলো এবার সরকারি গুদামে উচ্চমূল্যে ধান বিক্রি করেছেন। তাদের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র, কৃষক কার্ড এমনকি ব্যাংক একাউন্ট পর্যন্ত খোলা হয়েছে। গুদাম থেকে তাদের ধান বিক্রির মূল্য হিসেবে বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের পার শ্রীরামপুর গ্রামে। এবার পার শ্রীরামপুর গ্রামের ১৩১ জন কৃষকের নামে ধান বিক্রির কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। গ্রামবাসী বলছেন, এটা চরম দুর্নীতি। তাদের বঞ্চিত করে সরকারি মুল্যে অস্তিত্বহীন মানুষের নামে একটি মহল সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করেছেন।
লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করার কথা বলা হলেও প্রকৃত কৃষকরা দুর্নীতিবাজদের কারণে লাভবান হতে পারেনি। তাদের বঞ্চিত করে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজরা হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। আর এই ধান ক্রয়ের সঙ্গে জড়িত খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ। কৃষি বিভাগ ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন এক সঙ্গে অনেক কৃষক ভিড় করায় সবকিছু খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। খাদ্য গুদাম সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কালীগঞ্জ উপজেলায় ৪ হাজার ১৯৮ জন কৃষকের নিকট থেকে ২০১৮ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র ৬ নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে ৩৭৫ জন কৃষকের নিকট থেকে ১৮০ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়েছে। বাজারে সাড়ে ৬ শত থেকে ৭ শত
টাকা মূল্যে ধান বিক্রি হলেও সরকার খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে ১০৪০ টাকা মণ দারে এই ধান ক্রয় করেন। মূলত কৃষক যেন লাভবান হন সেই কারণে এই বেশি মূল্যে ধান ক্রয় করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্রয় কাজ শেষ হয়েছে, এমনকি ক্রয় শেষে তাদের বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। যা কৃষকরা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে উত্তোলন করেছেন। ধান ক্রয়ের নিয়ম সম্পর্কে খাদ্য বিভাগ জানিয়েছেন,
প্রথমে কৃষকরা আবেদন করবেন। সেই আবেদনগুলো থেকে লটারির মধ্যে নির্ধারিত কৃষক নির্বাচন করা হবে। এরপর কৃষক স্লিপ নিয়ে গুদামে যাবেন। সেখানে তারা ধানের কোয়ালিটি দেখাবেন, তারপর ধান দেওয়ার অনুমতি পাবেন। এর অনুমতির পূর্বে তাকে কৃষক কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে আসতে হবে। সঙ্গে থাকবে ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার। এগুলোর পর কৃষক ধান বিক্রি করবেন। এই ক্রয়ের সময় কৃষকের কৃষি কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ব্যাংক একাউন্ট সঠিক আছে কিনা তা গুদাম কর্তৃপক্ষ যাচাই করবেন। এতো নিয়মের মধ্যেও অস্তিত্বহীন মানুষগুলো কিভাবে ধান বিক্রি করলেন। উপজেলা প্রশাসন লটারির পর যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর করা তালিকা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড পার শ্রীরামপুর গ্রাম। এই গ্রামে ১৩১ জনের নাম রয়েছে, যারা ধান বিক্রি করতে পারবেন। তারা লটারিতে বিজয়ী হয়েছেন। সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, লটারির মাধ্যমে যে তালিকা করা হয়েছে সেই তালিকার ১৩১ জনের মধ্যে প্রায় ৯০ জনের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। নামগুলো ধরে ধরে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এই সকল নামে তাদের গ্রামে কোনো ব্যক্তি নেই। নান্টুর পুত্র সেকেন্দার আলী, কওছারের পুত্র আব্দুল মান্নান, ইছাহক আলীর পুত্র আব্দুর রহমান, আব্দুল মালেকের পুত্র রবজেল হোসেন, আনছার মন্ডলের পুত্র আজিবর রহমানসহ অসংখ্য নামের কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম জানান, তারা নামগুলো শুনে কিছুটা আশ্চার্য হচ্ছেন। কারা এই ভুয়া নামে ধান বিক্রি করলেন। আরেক কৃষক জানান, তাদের গ্রামের কোনো মানুষই সরকারি গুদামে ধান বিক্রির সুযোগ পাননি। যে নামগুলো সঠিক আছে তারাও এই তালিকার কোনো খবর রাখেন না। এ বিষয়ে গ্রামের নুর আলীর পুত্র কুরোত আলী জানান, তার নামে ধান বিক্রির স্লিপ হয়েছে, তিনি লটারিতে জয়ী হয়েছেন এসবের কিছুই জানেন না। তিনি সরকারি গুদামে কোনো ধান বিক্রি করেননি। একই কথা
জানান, গ্রামের দোকানে বসে থাকা একাধিক ব্যক্তি। কৃষকরা জানান, তারা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, কিন্তু তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বরাদ্ধ নেই।
কুরোত আলী আরো জানান, তাদের গ্রামের কেউ কোনো ধান বিক্রি করেছেন এমন খবর তারা পাননি। এদিকে কৃষি বিভাগে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই গ্রামে ১২১ জন কৃষকের কৃষি কার্ড রয়েছে। যাদের মধ্যে ওই ৯০ জনের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া যে ১২১ টি
কৃষক কার্ড রয়েছে তার নাম্বার ৪৪৩৩০৬১৮০১০৭৪ থেকে ৪৪৩৩০৬১৮০১১৯৪ পর্যন্ত। অথচ ধান ক্রয়ের তালিকায় মাত্র ২২ জনের নাম রয়েছে যাদের কার্ড নাম্বার দেওয়া হয়েছে হাজারের উপরের সংখ্যা, বাকিগুলো সবই হাজারের নিচে। এমনকি ০০৩০, ০০৪২, ০০৪৩ সহ একাধিক কার্ড একাধিক কৃষকের নামে দেখানো হয়েছে। এবিষয়ে ওই ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান জানান, তালিকা করার সময় দ্রুত সবকিছু করায় সবকিছু যাচাই করা সম্ভব হয়নি। একটি তালিকা তার সামনে দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল, তিনি স্বাক্ষর করেছেন। তালিকার সঙ্গে কৃষক কার্ডের মিল না থাকা প্রসঙ্গে তিনি জানান, নামের মিল না থকেল কার্ড নাম্বারের মিল কিভাবে থাকবে। এই সকল কৃষকের নামে অগ্রণী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখায় একাউন্ট করা হয়েছে। এই একাউন্ট করতে তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও কৃষক কার্ড ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দেখাতে হয়েছে। তারপর তাদের একাউন্ট হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যাবস্থাপক
শৈলেন কুমার বিশ্বাস জানান, তারা একাউন্ট কারার সময় কাগজপত্র নিয়েছেন। কেউ ভুয়া কাগজ দিলো কিনা সেটা খাতিয়ে দেখছেন। ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ওরফে ছানা পূর্বপশ্চিমকে জানান, সব মানুষের নাম তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া অনেকের ডাক নাম রয়েছে। তিনি জানান, তারা চেষ্টা করেছেন স্বচ্ছভাবে কাজগুলো করার। কৃষক যেন উপকৃত হন। খাদ্য পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ খাদ্য গুদাম জাহাঙ্গীর আলম জানান, যখন কৃষকরা ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন তখন প্রচন্ড ভিড় ছিল। যে কারণে অনেক কিছু দেখা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া যাচাই-বাছাই কমিটির তালিকা ধরে তারা ধান ক্রয় করেছেন। এখানে তাদের বেশি একটা করার ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্ণা রাণী সাহা জানান, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তিনি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজউদ্দিন আহম্মেদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেখানে কথা বললে বিস্তারিত জানা যাবে। আর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, তিনি ভোটার তালিকা যাচাই করে ওই নামগুলো পাননি। বিষয়টি তিনি মৌখিকভাবে ইউএনওকে অবহিত করেছেন বলে জানান। প্রসঙ্গত, এই ইউনিয়নের কালুখালী, মধুপুর সাহাপুর গ্রামের একাধিক কৃষকের নামে ধান বিক্রি হয়েছে। যাদের সঙ্গে কথা বললে তারা এর কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।