চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ ওমরাহ ফেরত করোনাভাইরাস আক্রান্ত মায়ের সংস্পর্শে থেকে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের এক বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন কক্সবাজার সরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষ। এ ঘটনার পর বৈঠকে থাকা চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের তিন কর্মকর্তাসহ ১৬ জন এখন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে আছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ভুগছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তী।
জানা গেছে, এইচএসসি পরীক্ষার কক্সবাজার অঞ্চলের কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকটি হয়েছে গত রোববার (২২ মার্চ) সকালে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তীর কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ, কলেজ পরিদর্শক জাহেদুল হক এবং কক্সবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ মিলিয়ে ১৩ জন বৈঠকে ছিলেন। অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা পরীক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই বৈঠকে কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
ওই অধ্যক্ষের ষাটোর্ধ্ব মা ও ছোট ভাই সৌদিআরবে ওমরাহ শেষে গত ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। দেশে ফিরে তিনি নগরীর নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর সড়কের ৬৪ নম্বর ভবনের দোতলায় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ওই ছেলের বাসায় ওঠেন। চান্দগাঁও একদিন অবস্থানের পর তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালীতে তার বাড়িতে চলে যান। সেখানে গত ২১ মার্চ (শনিবার) বিকেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ওই অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, রোববার সকালে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এসে বৈঠকে যোগ দেন। তবে একই গাড়িতে হাসপাতালে গেলেও সেভাবে মায়ের সংস্পর্শে আসেননি বলে দাবি এই শিক্ষকের।
এর মধ্যে মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) কক্সবাজারে করোনা আক্রান্ত নারী শনাক্তের বিষয়টি প্রকাশ হয়। রাতে চান্দগাঁও ও বাকলিয়ার দুই ভবন লকডাউন করা হয়েছে। কক্সবাজারে ওই নারীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া ডাক্তার এবং নার্সদের হোম কোয়ারনটাইনে পাঠানো হয়েছে।
ওই অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, মায়ের করোনা শনাক্তের বিষয়টি জানার পর তিনিও এখন হোম কোয়ারেনটাইনে আছেন।
মায়ের অসুস্থতা জেনেও বৈঠকে যোগ দিলেন কেন, জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেপুটি কন্ট্রোলারকে আমি বারবার বলেছি যে, আমার মা অসুস্থ। এখন আমার কোনো মিটিংয়ে যাওয়া উচিৎ হবে না। তিনি জোর করে আমাকে মিটিংয়ে নিয়ে গেছেন।’
তবে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, মায়ের অসুস্থতার বিষয়টি তিনি তাদের জানাননি। বিষয়টি জানা থাকলে তারা মিটিংয়ে আসতে দিতেন না।
নারায়ণ চন্দ্র নাথের দাবি, চেয়ারম্যানের কক্ষে বৈঠকের সময় সবার মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হয়। তিন থেকে পাঁচ ফুট দূরত্বে প্রতিটি চেয়ার বসানো হয়। চেয়ারম্যানসহ বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আসা কেন্দ্র কর্মকর্তাদের দূরত্ব ছিল প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তীর দাবি, বৈঠকে আসা সবাইকে কক্ষে ঢোকার আগে সাবান ও হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ানো হয়। কক্ষে ঢোকার পর স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ানো হয়। এরপর তারা বৈঠক করেন।
তবে বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে, চেয়ারম্যানের কক্ষে তিন থেকে পাঁচ ফুট দূরত্বে চেয়ার বসানোর মতো জায়গাই নেই। চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছাড়া বাকি সবাই কাছাকাছিই ছিলেন। এছাড়া তারা একে অপরের সঙ্গে করমর্দনও করেন।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, বৈঠকের আগেরদিন থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর কথা বিভিন্নভাবে শোনা যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও সভা-জনসমাগম স্থগিতের তাগাদা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র কর্মকর্তাদের নিয়ে রোববারের বৈঠকটি স্থগিত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন শিক্ষাবোর্ডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ কয়েকজনের আগ্রহে বৈঠক করা হয়। অথচ বৈঠকের পরপরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই অধ্যক্ষকে বৈঠকে এনে সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। মিটিংয়ে সোলায়মান ছাড়াও যে ১৫ জন ছিলেন, তাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের সঙ্গে যারা শিক্ষাবোর্ডে নিয়মিত কাজ করছেন, তাদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কক্ষে গিয়ে কুশল বিনিময় করেন। সব মিলিয়ে শিক্ষাবোর্ডে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষা তখনও স্থগিত করা হয়নি, সেজন্য মিটিং করেছিলাম। কিন্তু জানার পর আমরা আরও তিনটি মিটিং বন্ধ ঘোষণা করি। এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র কর্মকর্তাদের নিয়ে আমাদের পাঁচটি মিটিংয়ের শিডিউল ছিল। তিনটি করেছি। প্রতিটিতে ১৫-২০ জন করে ছিল। বাকি দুইটি আর করিনি। রোববারই আমাদের শেষ মিটিং হয়েছে।’
ওই অধ্যক্ষের বৈঠকে যোগদান নিয়ে তিনি বলেন, ‘উনার মা যে অসুস্থ বা করোনায় আক্রান্ত হবেন এটা তো আমরা জানতাম না। উনিও আমাদের মায়ের অসুস্থতার বিষয়ে কিছু বলেননি। যেটা হয়ে গেছে, ঝুঁকির কিছুটা তো আছে। তবে আতঙ্কের কিছু নেই। কারণ, আমরা দূরে দূরে ছিলাম। আর উনার মায়ের হলেও উনার তো করোনা নেই। এরপরও যারা বৈঠকে ছিলেন, সবাইকে হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
নিজ কার্যালয়ে বসে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ মোবাইলে বলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। কিছু হবে না। তারপরও আমরা তো কোয়ারেনটাইনে আছি। কাল (বৃহস্পতিবার) থেকে তো সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা তো আর বাসা থেকে বের হব না।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত নারীর দুই ছেলের বাসা যেখানে আছে, সেখানে দুটি ভবন আমরা লকডাউন করেছি। কক্সবাজার কলেজের যিনি অধ্যক্ষ, তিনি আক্রান্ত নন। এখনো তার অসুস্থতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারপরও মিটিং করা উচিৎ হয়নি। মিটিংয়ে যারা ছিলেন, এটা তো সবার জন্য অবশ্যই ঝুঁকি তৈরি করেছে। এখন সবার উচিৎ হোম কোয়ারেনটাইনে থাকা।’