চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ বরগুনার আমতলী থানায় এক কর্মকর্তার (ওসি-তদন্ত) কক্ষ থেকে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একটি হত্যা মামলার সন্দেহভাজন হিসেবে শানু হাওলাদারকে আটক করা হয়েছিল। পরিবারের অভিযোগ, থানার ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির দাবি করা তিন লাখ টাকা না দেওয়ায় নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা করেছে। তবে পুলিশের দাবি, শানু হাওলাদার আত্মহত্যা করেছে।
এ ঘটনায় আমতলী থানার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার মো. আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকালে বরগুনার আমতলী থানায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের কলাগাছিয়া গ্রামে ২০১৯ সালে বছর ৩ নভেম্বর ইব্রাহিম নামের একজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যা মামলার এজাহারে নিহত শানু হাওলাদারের সৎ ভাই মিজানুর রহমান হাওলাদারকে আসামি করা হয়। ওই আসামির ভাই শানু হাওলদারকে গত সোমবার (২৩ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকে সহেন্দভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমতলী থানা পুলিশ ধরে নিয়ে আসে।
শানু হাওলাদার
শানুর ছেলে মঙ্গলবার থানায় এসে তাকে খাবার দিয়ে যান। তবে বুধবার পরিবারের লোকজন এসে শানু হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। উল্টো পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তাড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ করে তার স্বজনরা। বৃহস্পতিবার সকালে থানা থেকে খবর দেওয়া হয় শানু হাওলাদার ওসি তদন্তের কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
তবে পরিবারের অভিযোগ, শানুকে ধরে নিয়ে আসার পরে আমতলী থানা ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি তার পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা মুক্তপণ দাবি করে। শানুর ছেলে ১০ হাজার টাকা ওসিকে দেন। দাবিকৃত বাকি টাকা দিতে না পারায় শানুকে থানা হাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা।
শানু হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার বাবাকে ওসি ধরে এনে তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছে। আমি ওসির দাবি করা টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমার বাবাকে নির্যাতন করেছে। বাবার ওপর নির্যাতন যাতে বন্ধ হয় সেজন্য মঙ্গলবার দুপুরে আমি ওসিকে ১০ হাজার টাকা দেই। কিন্তু টাকায় ওসি তুষ্ট হয়নি। নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। বুধবার সকালে আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে থানায় আসি। কিন্তু আমাকে দেখা করতে না দিয়ে ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়। ওসি বলে, টাকা নিয়ে আস, তারপর দেখা করতে দেবো।’
শানু হাওলাদারের স্বজনদের আহাজারি
নিহত শানু হাওলাদারের শ্যালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘দুলাভাইকে ধরে আনার পর থেকে আমি থানায় প্রাঙ্গণে ছিলাম। পুলিশ তাকে টাকার জন্য বেধরক মারধর করেছে।’
নিহত শানু হাওলাদারের স্ত্রী ঝরনা বেগম বলেন, ‘পাঁচজন পুলিশ যাইয়া সোমবার রাইতে মোর স্বামীরে বাড়ী গোনে ধইর্যা আনছে। আনার সময় মোর কাছে টাকা চাইছে। মুই টাকা দেতে রাজি অই নাই হেইয়্যার লইগ্যা মোর স্বামীকে পুলিশে পিডাইয়্যা মাইরা হালাইছে। মুই এইয়্যার বিচার চাই।’
আমতলী থানার ওসি মো. আবুল বাশার বলেন, ‘আসামী শানু হাওলাদার বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে ওয়াশ রুমে যাওয়ার জন্য বলে। সে ওয়াশ রুম থেকে ফিরে এসে এক ফাঁকে হাজত খানার ফ্যানের সঙ্গে গলায় রশি পেচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।’ কিন্তু হাজতখানায় কোনও ফ্যান নেই সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি পূর্বের কথা পাল্টে বলেন, ‘ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জনের কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।’ টাকা না দেওয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি জবাব এড়িয়ে যান।
আমতলী উপজেলা গুলিশালালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘শানু হাওলাদারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্যাতন করেছে। আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের সাজানো।’
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘থানার ওসি মো. আবুল বাশার টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি।’
আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান অভিযোগ করেন, ‘পুলিশ পরিকল্পিতভাবে শানুকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা শংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, ‘নিহত শানু হাওলাদারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছ। তবে ময়নাতদন্ত ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে না।’
এ ঘটনার তদন্তকারী প্রধান বরগুনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশাসন ও অপরাধ মোঃ তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, ‘দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই মো. আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’
বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেন, ‘এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পুলিশ টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক নিরপেক্ষ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’