চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃবিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় এক দশক তার সবচেয়ে ‘ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন’ হিসেবে শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের পরিচিতি ছিল রাজনৈতিক মহলে। এমনকি খালেদার গাড়ির সামনের সিটও বেশিরভাগ সময় থাকতো শিমুল বিশ্বাসের দখলে। বিএনপি প্রধানের এই ‘আস্থাভাজন’ ব্যক্তির দাপট ছিল নয়াপল্টনের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে শুরু করে গুলশানের চেয়ারপারসনের কার্যালয় এমনকি খালেদার বাসা ‘ফিরোজা’ পর্যন্ত। সেই শিমুল বিশ্বাসই খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তার কারামুক্তির আট দিনেও। একাধিক সূত্রের খবর, শিমুল বিশ্বাসকে ‘ফিরোজা’য় যেতে মানাই করে দেয়া হয়েছে হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় সূত্র জানায়, চেয়ারপারসনের ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে প্রভাব দেখিয়ে শিমুল বিশ্বাস অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর সেই শিমুল বিশ্বাস নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ‘ফিরোজা’য় ঢুকতে মানা করা হয়েছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিমুল বিশ্বাস বাম ছাত্ররাজনীতি করতেন। এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ খালেদা জিয়ার ‘বিশেষ সহকারী’ হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি, এ পদ তিনি কখন কীভাবে পেয়েছেন তা ছিল অনেক নেতারই অজানা। এই পরিচয়ে শিমুল বিশ্বাসের দাপটে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ফলে ক্ষোভ জমা হতে থাকে শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। তবে কেউ মুখ খোলেননি খালেদা জিয়ার বিরাগভাজন হওয়ার শঙ্কায়।
শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দলের নেতাদের অভিযোগ, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি প্রধানের যে ক’টি সিদ্ধান্ত ভুল বলে সমালোচিত হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে শিমুল বিশ্বাসের ইন্ধন ছিল। ঢাকা সফররত ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চায়ের দাওয়াতে সাড়া না দেয়া, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর মা খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশান কার্যালয়ে গেলেও দরজা থেকেই তাকে ফিরিয়ে দেয়ার মতো কিছু ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্তের পেছনে ছিলেন শিমুল বিশ্বাস।
কয়েকজন নেতার ভাষ্যে, তখন শিমুল বিশ্বাসের এমনই দাপট ছিল যে, গুলশান কার্যালয় বা ফিরোজায় খালেদার সঙ্গে দেখা করতে গেলেও অনুমোদন লাগতো এই ‘বিশেষ সহকারী’র। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিমুল বিশ্বাসের আগ বাড়িয়ে কথা বলা এবং খালেদার সঙ্গে নেতাদের দেখা করার ক্ষেত্রে তার বাড়াবাড়ি অনেককেই রুষ্ট করে। অনেক নেতাই শিমুল বিশ্বাসের কার্যকলাপ সন্দেহের চোখে দেখতেন।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে সেদিনই গ্রেফতার হন শিমুল বিশ্বাস। ২০১৯ সালের মে মাসে তিনি কারামুক্তি পান। পরে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন তিনি।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মানবিক বিবেচনায় গত ২৫ মার্চ সরকার শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কারান্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি দিলে সেদিন তিনি তার বাসা ‘ফিরোজা’য় ওঠেন। হাসপাতাল থেকে ‘ফিরোজা’ পর্যন্ত সার্বক্ষণিক খালেদা জিয়ার সঙ্গে গাড়িবহরে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শিমুল বিশ্বাস তার সঙ্গে থাকলেও মুক্তির দিন তাকে দেখা যায়নি। সেদিন ফখরুল ছাড়াও ছিলেন সিএসএফ’র ১২ সদস্য ও খালেদার বোন সেলিমা ইসলামসহ কয়েকজন আত্মীয়। বাসায় পৌঁছানোর পর খালেদাকে দেখে আসেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনসহ চিকিৎসকদের একটি দল। এরপর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির বেশ ক’জন সদস্য। কয়েকজন বিএনপি নেতা বলেন, দলীয় হাইকমান্ডের নিষেধাজ্ঞার কারণেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দিন বিএসএমএমইউতে যেতে পারেননি শিমুল বিশ্বাস। ফিরোজা এবং গুলশান কার্যালয়েও আপাতত যেতে পারবেন না তিনি।
‘ফিরোজা’য় যেতে মানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, ‘ম্যাডাম কোয়ারেন্টাইনে থাকাবস্থায় আমি তার কাছে যাচ্ছি না। আপনাকে দল এবং চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে গুলশানের বাসায় এবং কার্যালয়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের সঙ্গে তো আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। আমি কীভাবে বুঝব যে, আমি সেখানে নিষিদ্ধ। দলের পক্ষ থেকেও আমাকে কিছু বলা হয়নি। ১৫ তারিখ (১৫ এপ্রিল) যাক, তারপর সব বোঝা যাবে।