সারা বিশ্বে এখন আলোচনার প্রধান বিষয় কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। পৃথিবী জুড়েই এখন ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। করোনা ভাইরাস এখন মানুষের অন্যতম প্রতিপক্ষ। বিশ্বের সব জায়গাতেই করোনার বিপক্ষে মানুষ লড়াই করছে। অনেক মানুষ তার জায়গা থেকে নানা ধরণের সাহায্য ও সহযোগিতা করছে। কিন্তু সমাজের কিছু পেশার মানুষ করোনা ভাইরাসের বিপক্ষে অব্যাহতভাবে লড়াই করছে। এরা আমাদের সমাজের করোনা যোদ্ধা। এসব করোনা যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডাক্তার, নার্স, গবেষক, বিজ্ঞানী, ব্যাংকার, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সাংবাদিকরা।
এসব পেশাজীবী মানুষদের দায়িত্ব পালন করতে যেহেতু ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে । তাই করোনায় পেশার দিক থেকে ডাক্তার, নার্স, গবেষক, বিজ্ঞানী, ব্যাংকার, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সাংবাদিকরা খুবই ঝুঁকিতে আছে। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন,চীন, জার্মানিসহ অনেক দেশেই এসব পেশাজীবীর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। করোনায় তাই এসব পেশার মানুষদের বাড়তি সর্তক ও সচেতন থাকতে হবে। কারণ করোনায় এসব মানুষের সহযোগিতা ছাড়া লড়াই করা অসম্ভব। নিরাপদ জীবন সবার অধিকার। আর সবার আগে এসব করোনা যোদ্ধাদের জীবনকে রক্ষা করতে হবে। সেই জন্য প্রতিরোধমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সেগুলো মেনে চলতে হবে।
করোনায় প্রথম থেকেই অব্যাহতভাবে মাঠে ছিলেন সাংবাদিকরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের একজন করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন। করোনায় সাংবাদিকদের দায়িত্ব যেমন আছে তেমনি ঝুঁকিও আছে। পৃথিবীর সমস্ত দূর্যোগ ও বিপদের মধ্যেও এই পেশার মানুষরা জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে অব্যাহতভাবে কাজ করে গেছেন। মহামারি, যুদ্ধ,ঝড়, কিংবা দুর্যোগ সব সময়ই সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালনে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তবে কোভিড-১৯ এমনই ভাইরাস, একজন আক্রান্ত হলে আশেপাশের অনেক মানুষ আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। তাই সাংবাদিকদের নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সহকর্মীর জন্য এবং আশেপাশের মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সর্তক ও সচেতন থাকতে হবে। দেশের এই সংকটে হয়ত সব সাংবাদিকদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। আর সেজন্য দায়িত্বরত সাংবাদিকদের বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করে ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)’ সংগঠনটি। এই সংগঠনটি করোনার মধ্যে কিভাবে সাংবাদিকরা নিরাপদে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে সম্পর্কে বেশ কিছু করণীয় ও পরামর্শ প্রদান করেছে। সেইগুলোর আলোকে এবং বাংলাদেশের বিবেচনায় সাংবাদিকদের জন্য আরও কিছু করণীয় ও পরামর্শের সমন্বয়ে সাংবাদিকদের জন্য কতগুলো করণীয় ও পরামর্শ নিম্মে উল্লেখ করা হল।
১. মিডিয়ার অফিসগুলোতে কঠোরভাবে করোনা প্রতিরোধের নির্দেশনা মেনে চলা।
২. মিডিয়ার যেসব কর্মীরা ঘরে বসে দায়িত্ব পালন করতে পারবে; তাদের ঘরের থাকার ব্যবস্থা করা।
৩. করোনার সময় সাংবাদিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হওয়া।
৪. সাংবাদিকরা যেসব যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে; সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবানুমুক্ত রাখা।
৫. তথ্য সংগ্রহের সময় ঘড়ি, মানি ব্যাগ, মোবাইল, কার্ড ইত্যাদি জীবানুমুক্ত জায়গা রাখা।
৬. অফিসগুলোতে বারবার হাত ও মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা।
৭. প্রতিবেদন তৈরিতে বাইরে গেলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও পিপিই ব্যবহার করা।
৮. যথা সম্ভব সরাসরি ম্পটে না গিয়ে মোবাইল, ল্যাপটপের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নেওয়া।
৯. বয়স্ক সাংবাদিকদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া ও প্রয়োজনে ছুটি দেওয়া।
১০. বিপদজনক এলাকা (যেমন: হাসপাতাল, কবরস্থান ইত্যাদি) যথা সম্ভব এড়িয়ে চলা।
১১. বিপদজনক এলাকায় গেলে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রস্তুতি নেওয়া।
১২. কোন জায়গা প্রতিবেদন করতে গেলে সেই এলাকা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ খবর নেওয়া।
১৩. প্রবাসী, আক্রান্ত ব্যক্তি ও রোগীর স্বজনদের প্রতি ঘৃনা না ছড়ানো এবং শব্দ চয়নে সচেতন থাকা।
১৪. আক্রান্তদের নাম, ছবি ও পরিচয়ের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা।
১৫.স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন টার্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা।
১৬. অন্যান্য দেশে করোনা নিয়ে কি ধরণের প্রতিবেদন হচ্ছে সে সম্পর্কে খোজ রাখা।
১৭. করোনা নিয়ে যত মিথ ও ভুল তথ্য আছে; যথাযথ ব্যক্তি কর্তৃক তার সঠিক ব্যাখা দেওয়া।
১৮. বেশি করে পরামর্শমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
১৯. প্রতিবেদনে নেতিবাচক বিশেষণের (প্রানঘাতী, মহামারী, মৃত) হার কমানো।
২০.সামাজিক মাধ্যম থেকে যাচাই বাচাই করে তথ্য সংগ্রহ করা।
২১. করোনা বিষয়ে সরকারের নীতিমালা ও পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষণ করা।
২২. সাংবাদিকদের নেতিবাচক ও মানসিক দুঃচিন্তা কমানো।
২৩. সাংবাদিকদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো এবং নিয়মিত খোঁজ রাখা।
২৪. অফিসে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও খাবার গ্রহনে সর্তক থাকা।
২৫. বাইরে থেকে তথ্য সংগ্রহের পর ভাল মত পরিষ্কার ও জীবানুমুক্ত হওয়া।
২৬. করোনা নিয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ ও তথ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ রাখা।
২৭. করোনা নিয়ে ফেইক নিউজ ও গুজব সম্পর্কে সজাগ থাকা।
২৮. যাদের জ্বর, কাশি, সর্দি বা অন্যান্য রোগ আছে তাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা।
২৯. করোনার মধ্যে সাংবাদিকদের বেতন, ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা।
৩০. করোনার আজুহাতে কোন সাংবাদিককে চাকুরি থেকে বাদ না দেওয়া।
৩১. সমস্ত সাংবাদিকদের একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখা।
৩২. তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ মোবাইল নম্বর, মেইল, ফেইসবুক গ্রুপ ও ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করা।
৩৩. করোনায় যেসব সাংবাদিকরা কর্মরত আছেন, তাদের ঝুঁকি ভাতা প্রদান করা।
৩৪. তথ্য সংগ্রহের জন্য মিডিয়াগুলোর বিশেষ মোবাইল নম্বর চালু রাখা।
লেখক:: মো: উজ্জল তালুকদার, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।