অপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা লালার পরিবর্তে থুতু নিয়ে আসে * নমুনা সংগ্রহে ব্যবহার হচ্ছে ইউরিন কালেশন টিউব * এ ধরনের অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে -অতিরিক্ত সচিব * নমুনা সংগ্রহ থেকে সব বিষয়ে তদারকি করতে হবে -অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান
চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃসন্দেহভাজন করোনা আক্রান্ত রোগীদের নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা ও ফলাফল প্রদানে অসঙ্গতিগুলো দূর হচ্ছে না। যে রোগীর নমুনাই নেয়া হয়নি তাকে বলা হচ্ছে পজিটিভ। আবার ১৪ দিন হাসপাতালে থাকার পর প্রথম পরীক্ষায় বলা হচ্ছে নেগেটিভ এবং পরের পরীক্ষায় পজিটিভ। সংগ্রহকারীদের অনেকেই নিজে না করে রোগীদের হাতে কাঠি দিয়ে নমুনা আনতে বলেন। আবার অনেকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকায় লালার পরিবর্তে রোগীদের থুতু নিয়ে আসেন।
এছাড়া অধিদফতরের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নমুনা সংগ্রহের জন্য ইউরিন কালেকশন টিউব পাঠানো হয়েছে। এসব বিষয়ে নেই প্রয়োজনীয় তদারকির ব্যবস্থা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নমুনা সংগ্রহ থেকে ফলাফল দেয়ার পুরো প্রক্রিয়াতে নানা অসঙ্গতি লক্ষ করা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের প্রায় সর্বস্তরে করোনার সামাজিক সংক্রমণ শুরু হলেও অধিকাংশ রোগীর কন্ট্রাক ট্রেসিং করা হচ্ছে না। প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নতুন রোগীর যে হিসাব দেয়া হয়, সেখানে ফলোআপ রোগীরা যুক্ত কিনা তা স্পষ্ট করা হয় না। প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে সন্দেহজনক রোগীরা ফোন করে ১০ দিন অপেক্ষা করেও নমুনা দিতে পারছে না। ১৪ দিনের জায়গায় ১৭ দিন হাসপাতালে থেকেও দ্বিতীয় পর্যায়ের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করাতে পারেননি। এ অবস্থায় গোপনে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন এক রোগী। এমন সব অসঙ্গতির চিত্র আছে যুগান্তরের হাতে।
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেবেন।
একজন নারী চিকিৎসক তার মায়ের মৃতদেহ নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন ২১ এপ্রিল। যে হাসপাতালে তিনি ভর্তি ছিলেন সেখানে ডাক্তাররা তাকে কোভিড-১৯ সন্দেহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠান। তবে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসকরা নমুনা সংগ্রহ করতে পারিনি। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা মায়ের লাশ নিয়ে বসে থেকে উনাকে ফিরে যেতে হয়।
এর আগে নমুনা সংগ্রহের জন্য আইইডিসিআরে ফোন করা হয়। পরে আইইডিসিআর থেকে ওই নারী চিকিৎসককে জানানো হয়, তার মা কোভিড-১৯ পজিটিভ। যার শরীর থেকে নমুনাই সংগ্রহ করা হয়নি, তাকে পজিটিভ বলা হচ্ছে। তাহলে যে রোগী সত্যিকারের পজিটিভ, সেই রোগী কোথায় হারিয়ে গেল?
২৬ এপ্রিল মারা গেছেন এমন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা লক্ষণ প্রকাশের পর একবার নয়, দু’বার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়েছিলেন, ফল নেগেটিভ এসেছিল। পরে গুরুতর অসুস্থ হলে আবার পরীক্ষা করেন। মৃত্যুর পর জানা যায় তিনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।
হবিগঞ্জে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট গৌতম এন্ড্রো টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, পুরো জেলায় তিনি একমাত্র টেকনোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, এই জেলায় কমপক্ষে ২০ জন টেকনোলজিস্ট থাকার কথা সেখানে রয়েছে চারজন। এর মধ্যে একজন উচ্চতর শিক্ষায় ঢাকায় অবস্থান করছেন। একজন ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে চিকিৎসাধীন এবং অন্যজন কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
গৌতম জানান, সেখানে ইপিআই কর্মীরা নমুনা সংগ্রহ করছে কিন্তু যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা রোগীদের মুখের থুতু পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।
হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে তিনি দেখেছেন, নমুনা সংগ্রহকারীরা রোগীকে সোয়াব স্টিক (নমুনা কাঠি) হাতে ধরিয়ে বলছেন, নাকের ভেতর থেকে নমুনা আনতে। কিন্তু এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি তারা রোগীকেই বলছেন সোয়াব স্টিক টিউবে ঢুকিয়ে রাখতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লার একাধিক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট জানিয়েছেন, নমুনা সংগ্রহের জন্য তাদের কাগজে মোড়া সোয়াব স্টিক এবং সেটি সংরক্ষণের জন্য তার চেয়ে ছোট ইউরিন কালেকশন টিউব দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছে অদ্ভুত ধরনের ফেসমাস্ক। তারা বলেন, ওই স্টিক অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় সেটি টিউবে ঢুকবে না। ফলে নমুনা সঠিকভবে সংরক্ষণ করা যাবে না। এতে ওই নমুনা থেকে সঠিক ফল পাওয়া যাবে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আমি অন্তত ৫ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর কথা জানি, যাদের আইইডিসিআর থেকে শুধু রিপোর্টটি জানিয়ে দেয়া ছাড়া কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং সম্পর্কে একটা প্রশ্নও করা হয়নি। অন্তত ১০ জনের কথা বলতে পারি যারা ওই প্রতিষ্ঠানে নমুনা দেয়ার ৭-১০ দিন পর জেনেছেন উনারা কোভিড-১৯ পজিটিভ। সবচেয়ে আতঙ্কের কথা অনেককেই কোনো ধরনের রিপোর্ট বা এসএমএস দেয়া হচ্ছে না, শুধু ফোনে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। একেকটি রিপোর্ট দিতে ৩-৪ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। এর মধ্যে সেই রোগী অনেককে সংক্রমিত করে ফেলছে, কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ঠিকমতো নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে কিনা, ঠিকমতো পিসিআর (পলিমার চেইন রি-অ্যাকশন) মেশিন পরিচালিত হচ্ছে কিনা- এসব বিষয়ে যথাযথ তদারকি করা প্রয়োজন। সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ না হলে সঠিক ফল পাওয়া যাবে না। এতে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তিনি এসব বিষয়ে কঠোরভাবে সুপারভিশন (তদারকির) করার পরামর্শ দেন।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। তবে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। কোথায় ইউরিন টিউব গেছে সেটি নিশ্চিতভাবে জানতে পারলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, যখন কোনো সমস্যার কথা তিনি জানতে পারেন তখনই সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। যুগান্তর