চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ ব্যাংকের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি করে এবং কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের কাছ থেকে নিম্নমানের কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার কেনার পাঁয়তারা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি না নিয়েই ব্যাংকটির কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে গত ডিসেম্বর মাসে দুই শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ে ওই কোম্পানি থেকে সফটওয়্যার কেনার উদ্যোগ নেন। পরে অনিয়ম, দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যর বিষয়টি সামনে চলে এলে সফটওয়্যার কেনার প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
অগ্রণী ব্যাংকের বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সেই একই চক্র ভিন্ন কৌশলে ফের ফ্লোরা টেলিকম থেকেই সফটওয়্যর কেনার পাঁয়তারা করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জাহেদ বখত বলেন, গত ডিসেম্বরে ফ্লোরা টেলিকম থেকে সফটওয়্যার কেনার বিষয়ে আমি কোনোভাবেই অবগত নই। সফটওয়্যার কেনা কিংবা বাতিল এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না।
নতুন করে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার কেনা হচ্ছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহেদ বলেন, এখনো এই ধরনের কোনো প্রস্তাব বোর্ডে আসেনি। বোর্ডে প্রস্তাব এলে তখন আমরা বলতে পারব।
জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস উল ইসলাম বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের জন্য কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার কেনার রেট বেশি পড়ে যাওয়ায় আমরা গত ডিসেম্বর মাসের নেওয়া প্রকল্পটি বাতিল করেছি। বর্তমানে ফের কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার কেনার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করছি এবং বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবরও নিচ্ছি। যেভাবে কিনলে কমে পাওয়া যাবে, সেভাবেই আমরা সফটওয়্যার কেনার পদক্ষেপ নেব।
অন্যদিকে ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের ব্যবস্থানা পরিচালক (এমডি) মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউক বলেন, ‘আমি তো এ ধরনের কোনো কাজ পাইনি।’ নানা অনিয়ম বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার কল করা হলে এবং এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সূত্র জানায়, ব্যাংকের যেকোনো ধরনের কেনাকাটার জন্য আগে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু গত ডিসেম্বরে ফ্লোরা টেলিকমের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকার কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার কেনার উদ্যোগ নিলেও ওই সময় বোর্ডকে বিষয়টি অবহিতই করা হয়নি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অনেকটা গোপনে ফ্লোরা টেলিকমের কাছ থেকে অগ্রণী ব্যাংকের জন্য কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের (সিবিএস) আপগ্রেড সফটওয়্যার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর জন্য ২০০ কোটি টাকার বাজেট অনেক বেশি।
সূত্র জানায়, গত ২৯ ডিসেম্বর কোনো ধরনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে অগ্রণী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ্নুর বেগমের সই করা এক চিঠি পাঠানো হয় ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউকের কাছে। চিঠিতে ‘টেমেনস টি-২৪’ আপগ্রেডেশন প্রকল্পে ফ্লোরা টেলিকমকে (এফটিএল) নিযুক্ত করার বিষয়টি জানানো হয়। অথচ শাহ্নুর বেগম এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন না, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন ডিজিএম (টেকনিক্যাল) এনামুল মাওলা। তাকে পাশ কাটিয়েই ফ্লোরা টেলিকমকে চিঠি দেন শাহ্নুর বেগম।
চিঠির সূত্র ধরে ফ্লোরা টেলিকম ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের প্রিন্সিপাল (পিসিবিএস) বা সফটওয়্যার প্রোভাইডারকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। ওই চিঠিতে তারা সফটওয়্যার প্রোভাইডারকে নিশ্চিত করে যে তারা অগ্রণী ব্যাংকের জন্য ‘টেমেনস টি-২৪’ কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের আপগ্রেডের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
জানা যায়, পরে কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সফটওয়্যার প্রোভাইডার অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই চিঠির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। ব্যাংকের যে বিভাগ থেকে এই চিঠিটি ইস্যু করার কথা, সে বিভাগও এমন কোনো চিঠি সম্পর্কে অবগত ছিল না বলে জানায়।
সূত্র আরও জানায়, সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে সরকারে ক্রয় সংক্রান্ত নীতি না মানা, ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদন না নেওয়া ও নিয়ম বর্হিভূতভাবে ফ্লোরা টেলিকমের এমডিকে চিঠি দেওয়ার ঘটনা দ্রুতই জানাজানি হয়। ফ্লোরা টেলিকমের কাছ থেকে পাওয়া চিঠির সত্যতা সফটওয়্যার প্রোভাইডার না পাওয়ায় তারাও বিষয়টি তুলে ধরে। শেষ পর্যন্ত সমালোচনার মুখে ফ্লোরা টেলিকমকে দেওয়া কাজ বাতিল করা হয়। এখন উপযুক্ত দরে কাজটি কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলে অগ্রণী ব্যাংকের কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, বর্তমানে আবারও নানা কৌশলে সেই ফ্লোরা টেলিকম থেকেই দুইশ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার পাঁয়তরা করছে আগের চক্রটি।
ফ্লোরা লিমিটেডকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানতে শাহ্নুর বেগমের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে শামস উল ইসলাম এমডি বলেন, সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে নেওয়া পদক্ষেপে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার সুযোগও নেই। ফ্লোরাকে পরস্পর যোগসাজশে কাজ দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
এদিকে, একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফ্লোরা টেলিকম এর আগে মাইক্রোসফটের সফটওয়্যারের নকল লাইসেন্স শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বিক্রি করেছিল। ২০১৫ সালে ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি রাইটস (আইপিআর) ও কপিরাইট কর্মকর্তারা তাদের কাছ থেকে মাইক্রোসফট সফটওয়্যারের পাইরেটেড ভার্সনযুক্ত ৬৯টি ল্যাপটপ আটক করে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার নজিরও রয়েছে এই কোম্পানির।