চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃদেশে আসতে করোনা পরীক্ষার সনদ না লাগলেও বাংলাদেশ ত্যাগ করতে এই সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশই তাদের দেশে ঢুকতে এ সনদ বাধ্যতামূলক করেনি। বিদেশগামী ব্যক্তিদের সনদ সংগ্রহের জন্য দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১৪টি জেলায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সনদ পেতে তাদের দিতে হবে ১৭ গুণ অতিরিক্ত ফি। ফলে করোনা পরীক্ষা করানোর মাধ্যমে সনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের, যারা দেশে এসে আটকা পড়েছিলেন, এখন আবারও ফিরে যেতে চাচ্ছেন এবং যারা চাকরি নিয়ে এই প্রথম বিদেশ যাচ্ছেন।
অপরদিকে আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশের ভেতরে বা বিদেশ গেলে যাত্রীদের দিতে হবে যাত্রী নিরাপত্তা ও বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি। সব মিলিয়ে প্রবাসী কর্মীদের বিদেশ যেতে বেড়েছে বাড়তি চাপ ও ভোগান্তি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, গত ১২ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিদেশ গমনেচ্ছু যাত্রীদের কোভিড-১৯ মুক্ত সনদ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর গত ১৯ জুলাই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ২৩ জুলাই থেকে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে বিদেশ গমনকারী সকল এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের কোভিড পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক। কোভিড-১৯ পরীক্ষার বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়। বিদেশগামী যাত্রীকে বিমানযাত্রার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা জমা দিতে হবে। যেকোনও ব্যক্তির জন্য করোনা পরীক্ষার সরকার নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা। কিন্তু বিদেশগামী যাত্রীদের সশরীরে ল্যাব গিয়ে পরীক্ষার জন্য দিতে হবে ৩৫০০ টাকা এবং বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে ফি দিতে হবে ৪৫০০ টাকা।
দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১৪টি জেলায় বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার স্যাম্পল নেওয়া হবে। এসব স্যাম্পল পরীক্ষা করা হবে ১৬টি সরকারি হাসপাতালে। যেসব জেলায় স্যাম্পল সংগ্রহের বুথ রয়েছে, সেই জেলাগুলো হচ্ছে—ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, ঢাকা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, কক্সবাজার ও ফেনী—এই ১৩ জেলায় প্রবাসীর সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। যদিও বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলা প্রবাসীদের তালিকার শীর্ষে থাকলেও এই পাঁচ জেলার মানুষদের করোনা পরীক্ষা করাতে যেতে হবে কুমিল্লায়। কুমিল্লা জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ে একটি বুথের মাধ্যমে স্যাম্পল নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত স্যাম্পল নেওয়া হয়। জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ২০ জুলাই থেকে স্যাম্পল নেওয়া শুরু করেছি। কুমিল্লা ছাড়াও আমাদের লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনীসহ মোট ৫ জেলার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতগুলো জেলার মানুষের স্যাম্পল নিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্যাম্পল ল্যাবে পাঠাতে না পারলে সময় মতো রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবে না। তারপরও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।’
কোনও কোনও জেলায় সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে বিদেশিগামীদের করোনা পরীক্ষার নমুনা নেওয়া হলেও কোনও কোনও জেলায় নেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে। অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশগামীদের একবার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে, আবার ল্যাবে ছোটাছুটি বলা হলেও জনবল সংকটের অজুহাতে অনেক ক্ষেত্রেই বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহে আগ্রহী নয় নির্ধারিত ল্যাবগুলো। দিনাজপুরে বিদেশগামীদের নমুনা নেওয়া হচ্ছে এম. আবদুর রহিম মেডিক্যাল কলেজে। এই জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, ‘আমরা এম. আবদুর রহিম মেডিক্যাল কলেজে একটি ডেডিকেটেড বুথের ব্যবস্থা করেছি। সরাসরি সেখানে নমুনা দেওয়া যাবে। সকাল ৯টা থেকে নমুনা নেওয়া হবে। আমার অধীনে যে টিমটি আছে, তারা ফিল্ডে কাজ করে। তাদের যদি বিদেশগামীদের নমুনা সংগ্রহের কাজে জড়িয়ে ফেলি, তাহলে ফিল্ডের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া, আমরা নমুনা সংগ্রহ করলেও পরীক্ষা হতো আবদুর রহিম মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবেই। তাই সরাসরি সেখানেই নমুনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
এদিকে আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশে ভেতরে বা বিদেশ গেলে যাত্রীদের দিতে হবে যাত্রী নিরাপত্তা ও বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বুধবার (২২ জুলাই) এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছে। ওই আদেশে বলা হয়, ‘বেসামরিক বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে বিমানবন্দরগুলোর যাত্রী নিরাপত্তা, সেবার মান বৃদ্ধি এবং বিমানবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে সব বহিগামী যাত্রীদের এই ফি দিতে হবে। সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি দিতে হবে ৫ ডলার এবং যাত্রী নিরাপত্তা ফি দিতে হবে ৬ ডলার। সার্কভুক্ত ছাড়া অন্য দেশের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি দিতে হবের ১০ ডলার এবং যাত্রী নিরাপত্তা ফি দিতে হবে ১০ ডলার।’
করোনা মাহমারির কারণে দেশে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল চীন ছাড়া সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। ১৬ জুন থেকে সীমিত পরিসরে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল শুরু হয়। ফ্লাইট শুরু হওয়ার পর দেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিকরা নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের মে মাসে পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই এখন কোনও আয়ের উৎস নেই। ৫২ শতাংশ প্রবাসীর জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। ৭৪ শতাংশ প্রবাসী প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। ৩৪ শতাংশ প্রবাসীর নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই। ১০ শতাংশ প্রবাসী ইতোমধ্যেই ঋণ গ্রহণ করেছেন।’
প্রবাসী শ্রমিকরা বলছেন, করোনা টেস্টের জন্য প্রবাসীদের দিতে হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। আর এক জেলা থেকে অন্য জেলায় টেস্ট করাতে যাতায়াতসহ খরচ হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। একজন প্রবাসী শ্রমিকের আয়ের ওপরে পুরো একটা পরিবার চলে। দেশে ফিরে এসে তারা ছয় মাস ধরে বেকার। এই মুহূর্তে এত খরচ তাদের জন্য বাড়তি বোঝা। রেমিট্যান্স নিয়ে সবার এত গর্ব, এত উল্লাস, কিন্তু যাদের ঘামে রেমিট্যান্স আসে, তাদের ওপরে বাড়তি খরচের এই চাপ কতটা যৌক্তিক, এ প্রশ্নও তুলেছেন তারা। এছাড়া, ৬৪ জেলায় নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা না করায়, অন্য জেলায় যাতায়াতের সময় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘অনেক রাষ্ট্রই তাদের দেশে প্রবেশ করতে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট চাচ্ছে না। এছাড়া, সার্টিফিকেট নেওয়ার পরও যে কেউ যেকোনও সময় আক্রান্ত হতে পারেন। বিদেশফেরত প্রবাসীরা বর্তমানে সংকটে আছেন। এর ওপর টেস্টের যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা তাদের জন্য অনেক বেশি। শুধু টেস্ট নয়, যাতায়াত মিলিয়ে একেক জনের ১০-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি সবসময় সচল রেখেছেন। এই মুহূর্তে তাদের জন্য এ খরচ অনেক বেশি। অন্যদিকে ৬৪টি জেলার মানুষের জন্য মাত্র ১৪ জেলায় টেস্টের ব্যবস্থা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তারপরও যেসব জেলায় প্রবাসী বেশি, সেব জেলাকে গুরুত্ব দেওয়া হলে সমস্যা কম হতো।’
শরিফুল হাসান বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো হতো যদি বিমানবন্দরে প্রবেশের আগেই কোনোভাবে টেস্টের ব্যবস্থা করা হতো। তাহলে আর প্রবাসীদের নানা দিকে ছুটাছুটি করতে হতেো না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘বিদেশগামী যাত্রীদের সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যেয়ে নমুনা জমা দিতে হবে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা পরীক্ষার জন্য জমা দিতে হবে। নমুনা জমা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেওয়া হবে। বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষায় জন্য প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে আমরা সেন্টারের সংখ্যা আরও বাড়াবো।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বাংলা ট্রবিউনকে বলেন, ‘যে বিধি-বিধান হয়েছে তা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সার্টিফিকেট তো কোথাও লাগে না। ইতালির ঘটনার পর এসব বিধি-বিধানের বিষয়গুলো সামনে আসছে। এখন বিদেশে যেতে হলে করোনা টেস্ট করাতে হবে। এজন্য নির্দিষ্ট জেলায় আলাদা বুথ করা হয়েছে। করোনা টেস্ট তো আর প্রতি থানায় থানায় করা সম্ভব না। বাংলাদেশ এত ছোট দেশ, অল্প সময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যায়। এটাকে কঠিনভাবে দেখার কিছু নেই, ৬টি ল্যাবই তো যথেষ্ট।’
মাহবুব আলী বলেন, ‘অন্যান্য দেশে করোনা আক্রান্ত যাত্রী নিয়ে গেলে এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য জরিমানার বিধান করেছে। থাইল্যান্ডে করোনা আক্রান্ত যাত্রী নিলে এয়ারলাইন্সকে যাত্রী প্রতি ৫ লাখ বাথ জরিমানা দিতে হবে। সারাবিশ্বে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।