নারায়ণগঞ্জে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে রাজাকার পুত্রের প্রধান অতিথি হওয়ার ঘটনা নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। ১৪ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৭নং ওয়ার্ডের (বন্দরের) ঐতিহ্যবাহী কুড়িপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বন্দর উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাকসুদ হোসেন। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুজ্জামান বাবুল এবং ২৫, ২৬ ও ২৭নং ওয়ার্ড এর সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর হোসনেয়ারা বেগম উপস্থিত ছিলেন।
চেয়ারম্যান মাকসুদের পিতা মরহুম রফিক ছিলেন ওই এলাকার একজন কুখ্যাত রাজাকার। অভিযোগ রয়েছে, রফিকের নেতৃত্বে বহু বাঙালী হত্যাসহ ১৮টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এদিকে একজন রাজাকার পুত্রকে প্রধান অতিথি করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠান করায় স্কুল কমিটির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এলাকাবাসীসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও।
এলাকাবাসী বলছেন, গত কয়েক বছরে মাকসুদ চেয়ারম্যানকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠান করতে দেখিনি। এমনকি ওই স্কুলেও গত ২-৩ বছরে কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। কিন্তু এবার সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় মাকসুদ চেয়ারম্যান নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক হিসেবে জাহির করতে চাচ্ছেন। যে রাজাকার আলবদররা বুদ্ধিজীবী হত্যায় মূল ভূমিকা পালন করেছে সেই রাজাকারপুত্র এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে মায়াকান্না করছেন।
অপরদিকে নাম প্রকাশে ভীত স্কুল কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান মাকসুদ স্কুল কমিটির সভাপতি বলেই তাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। তবে গত ২-৩ বছরে বুদ্ধিজীবী দিবসের কোনো অনুষ্ঠান হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের কোনো জবাব মিলেনি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বন্দর উপজেলার মুসাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেনের বাবা চিহ্নিত রাজাকার রফিক ও তার ভাইদের অগ্নিসংযোগসহ নির্মম খুনের লোমহর্ষক কাহিনী এখনও আশপাশের গ্রামবাসীদের মুখে মুখে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের বই ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ এ রাজাকারের তালিকায় চেয়ারম্যান মাকসুদের বাবা ছাড়াও তার দাদা মাইনুদ্দীন, চাচা আবদুল মালেক ও সামাদের নাম রয়েছে।
রাজাকার রফিকের জীবদ্দশায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত অসংখ্য নিরীহ ব্যক্তিকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে বন্দর থানার রামনগর গ্রামের মগা প্রধান (দুঃইখ্যার বাবা), ধামগড়ের আইছাইল্লা মুন্সিকে প্রকাশ্য দিবালোকে, ধামগড় ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির মাস্টারের বড় ভাই গিয়াসউদ্দীন, তার নিকট আত্মীয় আমিনুদ্দীন, মতিউর রহমান এবং আবদুল হামিদকে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়।
রাজাকার রফিক গংরা কুড়িপাড়া, ধামগড়, হরিপুর, গোকুলদাসের বাগসহ ১৮টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওই সময় তাদের হাতে ১২ জনের অধিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তারা হল- কুড়িপাড়া গ্রামের লালু মিয়ার পুত্র মো. মুন্না, লালখারবাগের নাজির মেম্বারের পিতা ছিটু মুন্সি ওরফে (খাইট্টা ছিডা), আবদুল হকের পিতা খালেক, হরিপুরের ছলিমুদ্দিন প্রধানের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ, ছব্দর আলী, আবদুল হাকিমের পুত্র বছরুদ্দীন, আবদুল জব্বারের পুত্র সাহাদুল্লা, বঙ্গশাসনের শহীদুল্লাহর নাবালিকা কন্যা শাহিদা, আবদুল রব, সোনারগাঁ কুতুবপুরের আইয়ুব আলী ও আবদুল জাব্বার।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজাকার রফিক মিয়া লক্ষ্মণ খোলার আরেক রাজাকার আজিজ সরদারের নেতৃত্বে, বন্দর শিল্প এলাকা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করে গড়ে তুলেছিল বিরাট রাজাকার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের পরে প্রতিশোধ হিসাবে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার রফিকের ভাই ছাত্তার, মুস্তফা, কাবিল, তার জামাতা নান্নু, সঙ্গীয় সেলামতকে হত্যা করে। কিন্তু পালিয়ে বেঁচে যায় মূল হোতা রফিক ও তার পরিবার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন বঙ্গবন্ধু দালালি আইন পাস করেন। তখন রফিক গংদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ঢাকা জেলা জজ কোর্ট রফিকসহ তার পুত্র আত্মীয় স্বজন, রাজাকারদের মধ্যে ১৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোস্তাক আহম্মদ যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসার পর সে সময় এই দালালদের তিন ভাগের দুই ভাগ সাজা মাফ করে দিলে, কারামুক্ত হয় রাজাকার রফিক ও তার সঙ্গীয় রাজাকাররা।
এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন জানান, ওই স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার বাবা এবং আমি গত দেড় বছর আগে স্কুলের সভাপতি হয়েছি। কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা এলাকাবাসী অভিযোগ করে থাকলে তার নাম বলুন। তিনি দাবি করেন- তার বাবার নাম কোনো রাজাকার তালিকায় তিনি দেখেননি।