বিদেশে অর্থপাচার বিষয়ে দুদক, সিআইডি, বিএফআইইউ ও এনবিআরের তথ্য পর্যাপ্ত নয় বলে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যারা অবৈধভাবে গাড়ি বাড়ি তৈরি করেছেন তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চান আদালত। এর সঙ্গে জড়িতদের নাম জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ তথ্য দিতে পারেনি। কিন্তু আদালত এ সংক্রান্ত সব তথ্য হাতে পাওয়ার ব্যাপারে কঠোর। এজন্য এসব সংস্থাকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার মানি লন্ডারিং বিষয়ে তথ্য উপস্থাপনের পর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন।
এদিন দুদক, সিআইডি ও এনবিআর আদালতে অর্থপাচারের বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এতে উঠে আসে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুইয়াসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীদের নাম। সঙ্গে আসে ক্যাসিনো মমিনুল হক সাঈদের নামও। শতাধিক ব্যক্তির নামে প্রায় ২৫শ’ কোটি মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য দেয় দুদক। তবে এতে সন্তুষ্ট হননি আদালত। কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে যারা অবৈধ গাড়ি বাড়ি তৈরি করেছেন তাদের বিষয়ে চান সুনির্দিষ্ট তথ্য।
এসব প্রতিবেদন দেখে আদালত বলেন, এখানে ২২ অক্টোবর হাইকোর্টের দেয়া আদেশের পরের কোনো আপডেট তথ্য নেই। আমরা অর্থপাচারকারীদের নাম জানতে চাই। আপনারা নতুন নাম বলুন। সম্রাট তো কারাগারেই আছেন, আর নতুন করে অন্য কারা জড়িত তাদের নাম বলুন। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হলেও দুদক মাত্র ৪১ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। দেশের ১৮ কোটি মানুষ, তাদের মধ্যে গুটিকয়েক লোক অর্থ পাচার করে। তাদের সবার নাম জানার অধিকার আছে। আমরা অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা জানতে চাই।
অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, বিভিন্ন দেশে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোর মধ্যে ‘এগমন্ট চুক্তি’র কারণে অর্থপাচারকারীদের তথ্য চাইলেই আদালতে উপস্থাপন করা সম্ভব না। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অ্যাম্বেসিগুলোকে তথ্য জানাতে বলেছেন। আমাদের সময় দেন। পরে আদালত ফের দিন ধার্য করেন।
আদালতে দেয়া দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মানি লন্ডারিং অপরাধে মোট ৪৭টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং অপরাধে ৮৮টি মামলা বর্তমানে কমিশনে তদন্তাধীন। এসব মামলায় অন্তত একশ’ জন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। বিভিন্ন মামলা ও অনুসন্ধান শেষে ৪ ব্যক্তির বিদেশে সম্পদ ফ্রিজ করার তথ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সিআইডি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ সাতজন হ্যাকারদের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কায় অর্থ পাচার করেছে। শুধু সম্রাট এবং এনামুল হক আরমানই ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। কানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়ে সে দেশের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে হাইকোর্টকে জানিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইএইউ)।
এদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সব মিশন অর্থপাচারের রিপোর্ট দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা আদালতে দাখিল করা হবে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত দুদকের মামলার হিসাবে ২৫০০ কোটি টাকা অর্থপাচার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে দুদক।
আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তাহমিনা পলি।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে গত ২২ নভেম্বর স্বপ্রণোদিত হয়ে এক আদেশে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সব ধরনের তথ্য চান হাইকোর্ট। ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব, দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এরপর হাইকোর্টের আদেশের জবাব তৈরি করতে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে দুইবার বৈঠক করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সর্বশেষ গত সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে বৈঠক হয়।
বৈঠকে দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও এনবিআরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, রাজনীতিবিদরা নন, বিদেশে বেশি অর্থপাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।