শাহজালালসহ দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর দিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগী বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশ করছেন। সিভিল এভিয়েশনসহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কড়াকড়ি থাকার পরও প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। গত কয়েকদিনে শুধু শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েই করোনা সনদ ছাড়া যাত্রী এসেছে ৫শ’র বেশি।
একই ঘটনা ঘটেছে শাহ আমানত ও ওসমানী বিমানবন্দরেও। করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া কোনো যাত্রীকে বিমানে ওঠানো যাবে না বলে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকলেও সেটি মানছে না অনেক এয়ারলাইন্স । খোদ রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার বাংলাদেশ বিমানও সুযোগ পেলেই উপেক্ষা করছে সরকারের এই নির্দেশনা। ইতোমধ্যে এই নির্দেশ অমান্য করায় বিমান, সৌদিয়া এয়ারলাইন্স ও এয়ার এরাবিয়াকে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করা হয়েছে। লিখিতভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলোকে।
অভিযোগ আছে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকেও হেলথ টোকেন দিয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা। সেইসঙ্গে করোনা নেগেটিভ সনদ না থাকলেও অনেককে হেলথ টোকেন দেয়া হচ্ছে। এতে অনেক যাত্রীকে বিদেশ থেকে আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোও হয়েছে। সম্প্রতি শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ উল আহসান এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর একটি চিঠিও দিয়েছেন।
এতে বলা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী কোভিড-১৯ টেস্টের সনদ পরীক্ষা করে শুধু নেগেটিভ সনদধারীদের হেলথ টোকেন দেয়ার নিয়ম। কিন্তু ১৭ নভেম্বর দায়িত্বরত এক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর করোনা পজিটিভ সনদ থাকা সত্ত্বেও কয়েকজন যাত্রীকে হেলথ টোকেন দেন। সাউদিয়া এয়ারলাইন্সযোগে ওইসব যাত্রী সৌদি আরব গেলেও পরবর্তীতে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।
এছাড়া ২০ নভেম্বর হেলথ ডেস্কে দায়িত্বরত অপর এক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর যাত্রীর কোভিড-১৯ পজিটিভ সনদ থাকার পরও হেলথ টোকেন দেন। পরে ওই যাত্রীকে এয়ারলাইন্স কর্তৃক বোর্ডিং কার্ড ইস্যু না করে ফেরত পাঠিয়ে দেন। পরে তাকে বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য বিভাগ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে।
নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে কেউ দেশে এলে তার করোনা নেগেটিভ সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে আসার আগে সব যাত্রীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। শুধু নেগেটিভ সনদ থাকলেই তারা বাংলাদেশে আসার অনুমতি পাবেন। আর বিমানবন্দরে যাত্রীদের সেই মেডিকেল সনদ দেখাতে হবে। এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও বিমান সংস্থাগুলো সেটি মানছে না।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিএমইটি কার্ডধারী বাংলাদেশি কর্মীরা যে দেশে আছেন সেখানকার পিসিআর ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা সহজলভ্য না হলে তারা অ্যান্টিজেন বা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য পরীক্ষার সনদ নিয়ে দেশে আসতে পারবেন। এছাড়া বিমানবন্দরে কর্মরতদের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ যাত্রী, ক্রু ও উড়োজাহাজ জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে করতে হবে। বিশেষ করে চীন, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে চলাচল করা ফ্লাইটের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা কার্যকর।
কিন্তু অনেক বিমান সংস্থা এ নির্দেশনা মানছে না। সম্প্রতি ১০টির বেশি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে পাঁচশ’র বেশি যাত্রী করোনা সনদ ছাড়াই শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। কিছুদিন আগে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে মকবুল ও মহসিন নামে দুই যাত্রী করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেট থাকার পরও দেশে আসেন। পরে তাদের বিমানবন্দর থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্যবিধি না মানায় সৌদি এয়ারলাইন্সকে দুই লাখ টাকা জরিমানা
স্বাস্থ্যবিধি না মানায় সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কোর্ট। গত ১৫ ডিসেম্বর এ জরিমানা করা হয়। জানা গেছে, ১৪ ডিসেম্বর ২৫৯ জন যাত্রী নিয়ে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইট ঢাকায় আসে। ওই ফ্লাইটের কোনো যাত্রীর কাছে কোভিড পরীক্ষার সনদ ছিল না। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় অবতরণ করা সৌদি এয়ারলাইন্সের আরও দুটি ফ্লাইটে যথাক্রমে ৩ জন ও ২৫৪ জন যাত্রী আসে কোভিড পরীক্ষার সনদ ছাড়াই।
বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ জামিল জানান, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নীতিমালা ছাড়া যাত্রী আনতে হলে বিশেষ ছাড়পত্র থাকতে হবে। কিন্তু সৌদি এয়ারলাইন্সের কর্মীরা অনুমতিপত্র বা ছাড়পত্র কিছুই দেখাতে পারেননি। তিনটি ফ্লাইটের কোভিড সনদবিহীন ৫১৬ জন যাত্রী প্রায় এক কাপড়ে ঢাকায় এসেছেন। কেউ কেউ খালি পায়ে এসেছেন, অনেকের শীতের কাপড়ও ছিল না। সৌদি আরবের কারাগারে সাজা খেটে দেশে ফিরেছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিমানসহ সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে সৌদি আরব। হজ হয়েছে সীমিত পরিসরে। ওমরাহ পালনের সুযোগ এখনও সীমিত। এই অবস্থায় সৌদি এয়ারলাইন্স যখন কোভিড পরীক্ষা ছাড়া শত শত যাত্রী বিমানে তোলে এবং তাদের পাইলট ও কেবিন ক্রুরা সে সব যাত্রীর সঙ্গে ছয় ঘণ্টা আকাশযাত্রা করেন, তখন আমরা বিস্মিত হই। শুধু সৌদি এয়ারলাইন্সই নয়, এসব কারণে গত কয়েক দিনে দেশি-বিদেশি মোট ১০টি এয়ারলাইন্সকে মোবাইল কোর্টের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করায় বিমান, মালদ্বীপ ও এয়ার এরাবিয়াকে জরিমানা
স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে বিদেশ থেকে যাত্রী পরিবহন করায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকেও জরিমানা করেছেন বিমানবন্দর আদালত। মালদ্বীপের একটি এয়ারলাইন্সকে দুই লাখ ৩৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জানা গেছে, রিয়াদ থেকে ৪১৭ যাত্রী নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকায় আসে। ওই ফ্লাইটে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট না থাকায় ১০ যাত্রীকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত যাত্রী আনায় এয়ার এশিয়াকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে করোনায় আক্রান্ত যাত্রী দেশে আনায় এই জরিমানা করা হয়।
এয়ার এশিয়ার একটি ফ্লাইটে ৯৮ জন যাত্রীর মধ্যে একজন করোনায় আক্রান্ত রোগী ছিল। কুয়ালালামপুর থেকে পাওয়া সনদেও উল্লেখ ছিল তিনি করোনায় আক্রান্ত। বোর্ডিংয়ের সময় বিষয়টি লক্ষ্য না করায় ওই প্রবাসী বাংলাদেশে চলে আসেন। বিমানের একটি ফ্লাইট চার শতাধিক যাত্রীর মধ্যে ৬ যাত্রীর কাছে নির্ধারিত পিসিআর টেস্টের সনদ ও বিএমইটির রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে যাত্রী পরিবহন করায় বিমানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পরিচালকের চিঠি প্রসঙ্গে বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য ডেস্কের সহকারী পরিচালক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, ‘পজিটিভ রোগী এলে এয়ারলাইন্স সেটি ধরতে পারে। এখন থেকে কোনো পজিটিভ রোগী থাকলে সেটা রাউন্ড সার্কেল দিয়ে লাল কালি দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখাকে বলে দেয়া হয়েছে। সার্টিফিকেটের লেখাগুলো রেগুলার ফন্টের। ফলে নেগেটিভ এবং পজিটিভ ভুল হতেই পারে।
আর কিউআর কোড স্ক্যানার আসাতে তারা লেখা না দেখে কোড মেরে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘এখন যাত্রী অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন ৩০টি ফ্লাইট বিদেশ যাচ্ছে আবার আসছে। একই কাজ করতে করতে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। তবে ভুলের জন্য তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যদি এমন হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল-আহসান বলেন, আমরা চাই সবাই আরও সতর্কতার সঙ্গেও দায়িত্ব পালন করুক। একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি যদি দেশে-বিদেশে যাওয়ার হেলথ কার্ড পান তাহলে এটা দুঃখজনক। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি বিদেশে চলে গেলে সেসব দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।