রাজধানী ঢাকায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব অতিমাত্রায় বেড়েছে। দিন-রাত মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। কিউলেক্স মশা নির্মূলের মূল দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। কেননা, এ মশার প্রজনন স্থান খাল ও নর্দমা পরিষ্কার করা বা সেখানে মেডিসিন প্রয়োগ করা নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে কিউলেক্স মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার ব্যর্থতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলতি বছরে করোনাভাইরাস মোকাবিলা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর পাশে যেভাবে ছিলেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধন শ্রমিকদের দিয়ে যেভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ হয়েছে, এখন তেমন কোনো তৎপরতা নেই।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, সেসব ক্ষেত্রে তারা দুই সিটি করপোরেশনের দুর্বলতা দেখছেন। কেননা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা গেলে এই মশার উপদ্রব এত বৃদ্ধি পেত না।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা শহরের সর্বত্রই এখন কিউলেক্স মশার মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, পোস্তগোলা, ডেমরা, শ্যামপুর, দনিয়া, পল্টন, হাজারীবাগ এলাকায় মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ লোকজন। বাসাবাড়ি, অফিস সব জায়গার চিত্র একই। অভিজাত গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, উত্তরা, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারাও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নবগঠিত এলাকা ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণ এবং বাড্ডা, কুড়িল, জোয়ার সাহারা এলাকায়ও কিউলেক্সের সমান উপদ্রব লক্ষ করা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাড্ডার বাসিন্দা মো. মাসুদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘সারা জীবনের রোজগার দিয়ে একটি অভিজাত ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছি। কিন্তু মশার উপদ্রবে বাসায় টিকতে পারছি না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলেও কোনো লাভ হচ্ছে না।’
একই সুরে কথা বলেন কুড়িল চৌরাস্তা এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘মশার উপদ্রবে বাসা, অফিস কিংবা রাস্তাঘাট কোথাও টেকা যায় না। এখন সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীদেরও তেমন দেখা মেলে না। মশক নিধনের এ বেহাল অবস্থায় আমাদের নাকাল হতে হচ্ছে।’
পুরান ঢাকার জুরাইনের গৃহবধূ অনামিকা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, ‘মশার উপদ্রব দিন-রাত সব সময় একই। আমার ছোট দুটো বাচ্চা আছে। ওদের নিয়ে এই করোনাকালে মশার কামড়ে দিশেহারা অবস্থা।’
এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘কিউলেক্স মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের, এটা নগরবাসীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কেননা, কিউলেক্স মশার প্রজনন স্থান ডোবা, নালার জমে থাকা পানিতে। আর ঢাকা শহরে এটা পরিষ্কারের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। এসব কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হলে কিউলেক্স মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘ডোবা, নালা বা জলাশয়ের পানি পচে গেলে সেখানে মশার প্রজনন ঘটে। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার ডোবা-নালাগুলোর সে অবস্থা হয়। আর এসব ডোবা, নালা বা জলাশয়ে কচুরিপনা থাকলে সেটা কিউলেক্স মশার প্রজননে আরও সহায়ক হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরে কিছু গভীর ড্রেন করা হয়েছে মশার প্রজননের কথা চিন্তা না করে। কেননা, এসব ড্রেনে সবসময় পানি জমে থাকে। আর সেসব জায়গায় সঠিকভাবে মশার ওষুধ ছিটাতে পারছে না সিটি করপোরেশন।’
এক প্রশ্নের জবাবে এ কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘ফোর্থ জেনারেশনের ওষুধ তিন মাস কার্যকর থাকার কথা থাকলেও সেটা এক মাসের বেশি থাকে কিনা সেটা যাচাই করে দেখতে হবে। এছাড়া ডিএনসিসি সেটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। কেননা, পদ্ধতিগতভাবে ওষুধ সঠিক। কিন্তু সেটার সঠিক প্রয়োগ করা না হলে কার্যকর সুফল মিলবে না।’
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, ‘বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। প্রতি বছরের এ সময়ে একই চিত্র থাকে কিউলেক্স মশার।’ তিনি বলেন, ‘কিউলেক্স মশার প্রজনন স্থানগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে এসব মশার উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য ডোবা, নালা বা জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। সঠিক নিয়মে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, ‘মশক নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি ফোর্থ জেনারেশনের ওষুধ আমদানি করেছে। স্বচ্ছ পানিতে সেটা বেশ কার্যকর। কিন্তু কচুরিপানাযুক্ত জলাশয়ে সেটা তেমন কাজ করছে না। এজন্য আমরা আগামীকাল (আজ) থেকে শহরের ডোবা, নালার কচুরিপানা পরিষ্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এছাড়া রুটিন অন্যান্য কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এগুলো কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আশা করি।’